---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
আমার এক ভারতীয় বন্ধু আফগানিস্তানের টোলো নিউজে কাজ করতো৷ ওর না না গল্প শুনে আমার ও লোভ হতো ডলারে কামানোর। ও বলতো, ভাড়া বাড়ি ঠিক করে দেওয়ার মতো অফিস ওদের পাঁচ তারা হোটেলেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। আসা যাওয়া অফিসের গাড়িতে, সামনে মিলিটারি জিপ৷ হোটেল টু অফিস, অফিস টু হোটেল। মাঝে আফগান সেনার চেকিং, হোটেলে ঢোকার আগে চারবার চেকিং। মানে এক্কেরে থ্রিলিং একটা ব্যাপার। এটাই ক্রমশ ওর দুনিয়া হয়ে গেছিল৷
বেশ কিছুদিন হলো আমি এবং আমাদের অফিসের কয়েকজন এই হোটেলেই বন্দি। আরো সাত দিন থাকবো। হোটেল থেকে অফিসের গাড়িতে মাস্ক পরে অফিস আর হোটেল ফেরত, অফিসে আমরাই কয়েকজন হোটেল থেকে আসছি, লাইভের আয়োজন করছি, হোটেলে ফিরে যাচ্ছি। এসবটা করা কারণ দা শো মাস্ট গো অন!
আমাদের ও রাস্তায় চারবার চেকিং, কারফিউ পাস দেখানো, অফিসে ঢোকার মুখে চেকিং, মাথায় বন্দুক সদৃশ যন্ত্র ঠেকিয়ে বডি টেম্পারেচার মাপা, স্যানিটাইজ করা, হোটেলে ফিরে নরম আলোয়, নরম তোয়ালে দিয়ে ফ্রেশ হওয়া, আলাদা আলাদা খাওয়া, নিজের মতো ফিরে আসা ঘরে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দরজা বন্ধ করে ঘুম! কাল ফের একইরকম এক সকাল।
তাজ হোটেলের নামেই শিহরণ জাগে মধ্যবিত্ততায়। সেই দিল্লির সদা গমগমে তাজ হোটেলই Post Apocalypse কোন সিনেমার প্রথম দৃশ্য যেন। পিয়ানোটা বন্ধ পরে আছে। ক্যাপিটাল কিচেনের মতো রেস্তোরাঁ যেখানে সাধারণ দিনে ও এক ঘন্টা অপেক্ষা করে লোকে আর পাঁচ-ছয় হাজার টাকার বিল মিটিয়ে উঠে চলে যায় মোটা টিপস রেখে, সেখানে খাঁ খাঁ করছে। সদর দরজাতে ও তো ওই ইয়া গোঁফওয়ালা পাগড়ি পরা লোকটা নেই। বাইরে সিআইএসএফ ঘরের চাবি আর আইডি চেক করছে।
তাজ হোটেল ও বন্ধ কিন্তু কিছু ঘরে সাকুল্যে ৫০জন মতো জরুরি পরিষেবার সাথে যুক্ত মানুষেরা আছেন। এই যেমন সাংবাদিক বা ডাক্তার বা আটকে পরা বিদেশি কূটনীতিক। এরা সব্বাই আলাদা আলাদা ব্লকে। কারা কারা আছে সেটা একে অপরে জানে কিন্তু কেউ কাউকে দেখতে পায় না। কেউ কারোর জন্য হাততালি দিতে পারেনা। পাছে জীবাণু ছোবল মারে। দেখার মধ্যে কয়েকজন তাজের স্টাফ। ওরা ও আমাদের মতো টানা ১৪দিন কাজ করে বাড়ি যাবে। দূরে দূরে বসে ওরা ও সুখের গল্প করছে, যা দরকার সাথে সাথে দিয়ে যাচ্ছে। ভয়ের গল্প করছে। এই ভয় তাজের সেই ব্রিটিশ ভূতের না। এই ভয় হোটেল শিল্পের মন্দা পরিস্থিতির। দেশে মন্দা চলছিলই, তার সাথে যুক্ত হলো লকডাউন। শ্রমিক তো সব্বাই, পেটে জ্বালা তো সবারই হয়। কারোর আগে কারোর পরে। কেউ গামছা গলায়, কেউ হোয়াইট কলারে।
জুলিয়ান আসাঞ্জ এর কথা আসলেই ভাবতাম সে বন্দিদশা আর এমন কি? দূতাবাসে আলিশান জীবন। খাচ্ছে দাচ্ছে ব্লগ লিখছে। ওমার আবদুল্লাহর ও তো তাই। ধন্যবাদ তাজ স্বাধীনতার মানে উপলব্ধি করাবার জন্য। এসময় পাখিরা দিল্লিতে ফিরে এসেছে। এই চাণক্যপুরী অঞ্চলে তো আরো গাছ, সবুজ ঘাস। সাথে ঝকঝকে নীল আকাশ।
এই সময় পাখিগুলোকে দেখে বড্ড হিংসে হচ্ছে। হিংসে হচ্ছে ওই কাঠবিড়ালিটাকে দেখে। ওকে কেউ বলে দেয়নি, ওই একটা গাছ থেকেই ওকে খুঁটে খেতে হবে। হিংসা তো তাদের জন্যও হচ্ছে যারা গরম ভাত আর ডিম সেদ্ধ মাখন দিয়ে খাচ্ছে নিজের ঘরে। ইচ্ছে তো হচ্ছে নিজের রান্নাঘরে ওই খুব সাধারণ কালচে কড়াইয়ে একটা ডিম ভাজতে।
জাহাজ করে প্রথমবার সমুদ্র সফরের প্রথম আধ ঘন্টা যেমন দারুণ রোমাঞ্চকর আর তারপর যেদিকে তাকাও নীল জল, দিগন্ত বিস্মৃত নীলিমা, এই পাঁচ তারা হোটেলে বিচ্ছিন্নতা যাপন ও তাই। প্রথম তিনদিন দারুণ লাগে কিন্তু তারপর ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, প্রিয়জনের সাথে বিকেলে কালো চা আর চালভাজা খেতে খেয়ে খবর দেখতে ইচ্ছে করে, ভুলে ফেলে আসা ওষুধের স্ট্রিপটা মনে পরে ফ্রিজের মাথায়, তারপাশে ফটোফ্রেম!
আফগানিস্তানে বড় সাংবাদিক ছিল যে বন্ধুটা সে বেমালুম এসব চেপে গেছিল। ওর ও এসব হতো৷ ওর ও ভয় করতো ঘরের জন্য, ওর ও পাঁচ তারা হোটেলের এই দিগন্ত বিস্মৃত ঐশ্বর্য দেখে দেখে নতুন কিছু দেখতে ইচ্ছে করতো৷ ও বলেনি, আর প্রাচীন প্রবাদ মেনে আমি ভাবতাম নদীর এপার কহে ছাড়িয়ে নিশ্বাস....
স্বাধীনতা আর মুক্ত হওয়া যে কি বিশাল এক পাওনা, সেটা যতক্ষণ না কেউ আটকে পরছে উপলব্ধি করতে পারেনা। তাই হয়তো পরে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো কিছু একটা অর্জিত স্বাধীনতাকে ভাবে। পাখিকে যতোই তুমি আখরোট খাওয়াও, সোনার খাচায়, রুপোর বাটিতে জল খাওয়াও, পাখি নীল আকাশে একদিন ঠিক পারি দেবে। রোজ ক্যালেন্ডার দেখবে, ডায়েরি লেখার পরে, তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস। আজ এখানেই শেষ।
©---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
No comments:
Post a Comment