| পালঘর এবং ইল্বল- বাতাপির ভারতবর্ষ |
---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
যা নেই ভারতে তা নেই ভারতে। আমরা রামায়ণ আর মহাভারত নিয়ে অহংকারই শুধু করলাম, আত্মস্থ করলাম না। আমাদের চারপাশে যা যা ঘটে চলেছে তার সবটা মহাভারতে লেখা। স্রেফ খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু শত খুঁজে ও এটা বুঝতে পারবেন না কেন আপনজনের মৃত্যু-শোকের চেয়ে এই সময় জরুরি হয়ে পরছে কে কাঁদলো আর কে কাঁদলো না।
সব মৃত্যু নিয়েই কি লিখি আমরা? সব খুন নিয়ে কাব্য করি? মোমবাতি জ্বালাই? তবে পালঘর নিয়ে কে কে লিখছে আর কে কে চুপ তা নিয়ে লোক ভীড় করছে কেন? আচ্ছা কৃষক আর শ্রমিকরা যদি একদিন ধরে ধরে আমাদের জিগ্যেস করে, কোথায় ঢুকে গেছিল কলম যখন আমরা হাঁটতে হাঁটতে অসুস্থ হয়ে মারা গেছিলাম বা রাতে হাইওয়েতে ট্রাক পিষে চলে গেছিল বা ফসলের দাম পাচ্ছি না বলে আত্মহত্যা করেছিলাম বা মুখে ইঁদুর নিয়ে প্রতিবাদে।
হিন্দুত্ববাদী দল শিবসেনার দখলে মহারাষ্ট্র। সেখানকার পালঘর জেলায় তিনজন হিন্দুকে পিটিয়ে মেরে দেয় হিন্দু দলিত সম্প্রদায়ের শ'খানেক মানুষ। এদের মধ্যে দুজন সাধু, একজন ড্রাইভার। দুজনই জুনাগড় আখাড়ার সদস্য। জুনাগড় আখাড়া সাধু সন্তদের বহু প্রাচীন এক মন্ডলি৷ কিছুদিন আগে শিরোনামে ফের আসে দলিত এক সদস্যকে আখাড়ার মহন্ত হিসেবে অভিষিক্ত করে৷ অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায় নিহত দুই হিন্দু দলিত বিদ্বেষী ছিলেন না। দলিত মানুষগুলো ও নিশ্চিত জুনাগড় আখাড়ার নাম শুনেছেন। তবে? পিটিয়ে মারা হলো কেন?
১১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এই অপরাধে। না কোন মুসলিম হিন্দুর উপরে বদলা নিয়েছে বা গ্রাহাম স্টেইন্স এর মতো শুধুমাত্র খ্রিস্টান বলেই গাড়িতে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বা সাধুদের ফ্রিজে নিষিদ্ধ পনির ছিল বলে মারা হয়েছে বা গো-প্রেমী বলে খুন হতে হয়েছে, এরকম কোন দিক পেলাম না খবরে। ভিডিওতে দেখলাম পুলিশের অপদার্থতার জন্য লোকগুলোকে মরতে হলো৷ পাগলের মতো অত লোক থানার সামনে দেখে ও পুলিশ জনতার হাতে তুলে দেয় তিনজনকে। তবে কি পুলিশেরা জেহাদি? দুজন সাসপেন্ড হয়েছে। কোন মৌলবাদী -কট্টরপন্থী বা জেহাদি যোগ নেই। স্ট্রেঞ্জ৷
যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানকার পঞ্চায়েত বিজেপির দখলে৷ সরপঞ্চ বিজেপির এক সদস্য। তিনজন মানুষ স্রেফ খুন হয়ে গেল। সেটা নিয়ে হাহাকার না করে সবাই উঠে পরে লাগলো কে কে কাঁদছে না তার নীতিপুলিশি করতে। আচ্ছা ঘরে কেউ মারা গেলে ঘরের লোক কি শোক প্রকাশ করে, নিজেরা কাঁদে না হাতা গুটিয়ে পাড়াতে লাঠি হাতে দেখতে বেরোয় কে কে এখনো কাঁদেনি। স্ট্রেঞ্জ না? এতে কি সাধুদের প্রতি সম্মান দেওয়া হলো?
আমরা বিগত কয়েক বছরে ইল্বল ও বাতাপি নামক দুই রাক্ষসকে পুষেছি। তারা এই কয়েক বছরে আদর যত্ন পেয়ে বিশাল রুপ ধারণ করেছে। গুজব বা ফেক নিউজ এবং পিটিয়ে মারার সংস্কৃতি। মহাভারত মতে ইল্বল ও বাতাপি দুই ভাই, দুজনেই রাক্ষস বা অসুর। তারা পথিকদের আপ্যায়নের লোভ দেখিয়ে ঘরে নিয়ে আসতো। ইল্বল খাবার রুপ ধারণ করতো৷ বাতাপি সেই খাবার পরিবেশন করতো। অতিথি সেই খাবার রুপী রাক্ষসকে চেটেপুটে খেতো। তারপর ইল্বল পেটে ঢুকে অতিথির নাড়িভুড়ি কামড়ে পেট চিঁড়ে বেরিয়ে আসতো। তারপর দুই ভাই অতিথির মাংস খেতো।
ভারতে ও তাই হচ্ছে। আমরা ভাবছি হিন্দু মারছে মুসলিমকে আর মুসলিম মারছে হিন্দুকে। ইল্বল মানে গুজব বা ফেক নিউজ লোক ভুলিয়ে, লোক ক্ষেপিয়ে এক জায়গায় সবাইকে জড়ো করছে। তারপর বাতাপি মানে Lynch Mob বা পিটিয়ে মারার সংস্কৃতি বাকি কাজটা সম্পন্ন করছে। ইল্বল- বাতাপিকে আটকানোর বা বিনাশের কোন চেষ্টা কেন্দ্র বা ভারতের প্রধান শাসক দল এই কয়েক বছরে করেনি। বরং পিটিয়ে মেরেছে যারা তাদের ফুল চন্দন নিয়ে বরন করেছে, জামিন দিয়েছে, অভিবাদন জানিয়েছে।
ইল্বল- বাতাপির বিনাশ করেছিল অগস্ত্য মুনি। প্রতিবারের মতো এবার ও ব্রাহ্মণ মাংস খাওয়ার লোভে ইল্বল আর বাতাপি এক বামনকে ভোজনের আমন্ত্রণ জানালো। ঘটনাচক্রে এবার অগস্ত্য এলো খেতে।অগস্ত্যের খাওয়া শেষে ইল্বল বাতাপি'কে উচ্চস্বরে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু বাতাপি অগস্ত্যের পেট থেকে বের হলো না। তখন অগস্ত্য জানালেন যে, বাতাপি সম্পূর্ণরূপে হজম হয়ে গেছে। এতে ইল্বল ভীত হয়ে, অগস্ত্যকে তার বাঞ্ছনীয় সম্পদ দান করে বিপদমুক্ত হন। কোনদিন আর ওই হত্যালীলা চালায়নি দুই ভাই।
আমাদের ও একটা অগস্ত্যের দরকার। সরকার চাইলেই অগস্ত্যের আগমন হবে ইল্বল- বাতাপিকে শায়েস্তা করতে। অগস্ত্য এক্ষেত্রে গণ পিটুনি প্রতিরোধ বিল। প্রোটেকশন ফ্রম লিঞ্চিং বিল ২০১৯। অবিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো এই বিল পাশ করেছে কিন্তু বিরোধিতা করেছে বিজেপি। দেশে এটা চাইলেই আইন হতে পারে। গণ পিটুনি বা মিথ্যে খবর -গুজব ছড়ালেই কঠোর থেকে কঠোর সাজা হবে। হচ্ছে না। ভগবানই জানে কেন অগস্ত্যের জায়গায় ইল্বল- বাতাপির মতো দুই রাক্ষসকে জিইয়ে রেখেছে সরকার।
পরের বার ফের হিন্দু মুসলমানে ভাগ করতে এলে, ফের জাতের নামে বজ্জাতি করতে এলে প্রশ্ন করুন কেন ইল্বল- বাতাপির মতো ফেক নিউজ আর গণ পিটুনিকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। কেন এদের জব্দ করা হচ্ছে না। গোটা দেশ প্রশ্ন করলে দেখবেন ঠিক জব্দ হবে।
পুনশ্চঃ যেদিন অগস্ত্য ইল্বল- বাতাপির ঘরে খেতে আসে, ইল্বল অগস্ত্যকে হত্যা করার জন্য সুস্বাদু মেষরূপী বাতাপি'র মাংস পরিবশন করেছিল নাকি৷ শোনা যায় সে সময় ঋষি মুনিরা মেষ-মাংস ও মদিরা খেত। অবশ্য এখন খেলে অগস্ত্যকেই হয়তো পিটিয়ে মারা হতো৷ ছ্যা ছ্যা! যাক গে সে সব ম্লেচ্ছ- কথা! হরি ওম তৎ সৎ।
©----- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
No comments:
Post a Comment