| শুভ জন্মদিন সাদাত হাসান মান্টো |
---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
মান্টো মরে না। হঠাৎ পথ ভুল করে, কাঁটাতার পেরিয়ে পাশের দেশে ঢুকে পরা ভবগুরে, দেহ ব্যাবসায়ীর লুকোনো ডায়েরির খাঁজে, বারেবারে ধর্ষিতা হয়েছিল যে মেয়েটি তার যে কোন জায়গা থেকে স্রেফ "খোল" শব্দবন্ধ শুনলেই পাজামার ফিতে ঢিলে করায়, দেশভাগের পোড়া মাংসের "বু"তে, আমাদের পচে গলে যাওয়া বিবেকবোধে মান্টো জিন্দা হে!
দিল্লিতে একটি লাহোরি গেট আছে আর লাহোরে আছে একটা দিল্লি গেট৷ আশ্চর্যভাবে দুটো দ্বারেরই অভিমুখ একে অপরের দিকে। লাহোরি গেট সত্যিই লাহোরের দিকে তাকিয়ে থাকে আর দিল্লি গেট দিল্লির দিকে ফ্যালফ্যাল করে৷ সত্তর বছর ধরে।
ব্যাঙ্গালোরে এক সিন্ধী পরিবার একটি খুব জনপ্রিয় বেকারি চালান। সিন্ধীরা পাকিস্তানের হিন্দু উদ্বাস্তু ছিল৷ সিন্ধ এর মানুষ। এই 'গদ্দার' পরিবার ছিল করাচির৷ ফেলে আসা ভিটেমাটির নামেই নাম রাখা করাচি বেকারি। কি অদ্ভুত যেখানে থেকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিলো সেই শহর বুকে করে আজ ও ঘুরছে।
করাচিতে পাক সাংবাদিক বন্ধুর থেকে জানলাম এখনো সে শহরে জ্বলজ্বল করে বম্বে বেকারি, দিল্লি নিহারি, আম্বালা সুইটস, মিরাঠ কাবাব হাউস, মাদ্রাস ক্যাফের মতো দোকান৷ এখনো করাচিতে বহুল জনপ্রিয় সোনার দোকানের নাম ক্যালকাটা জুয়েলার্স। এখনো বেনারস কলোনি আছে ওখানে৷ মাদ্রাসী আর বাঙালিদের গলি আছে যেখানে ভালো মাছ পাওয়া যায় বাজারে। পাকিস্তানি মাছ বা জলের তাজা মাছ।
লাহোরের সবচেয়ে বড় হাসপাতালগুলোর মধ্যে অন্যতম হাসপাতালের নাম গঙ্গারাম হাসপাতাল। দিল্লির ও তাই। শেঠ গঙ্গারামের সমাধি ও লাহোরেই। হিন্দু মানুষটি আর ভারতে চলে আসেননি। দু দেশের মাটিতেই তার নিশ্বাস প্রশ্বাস রয়ে গেছে৷
এরকম বহু ভারতীয় নাম, ভারতীয় শহরের নাম, মানুষের নামের সাইনবোর্ড গোটা পাকিস্তানে ঝুলছে। জ্বলজ্বল করছে নস্টালজিয়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলছে ক্ষয়ে যাওয়া রঙ দেশভাগের পরে। এরকমই কোন দোকানে হয়তো শফিকুল আর শ্যাম একসাথে আড্ডা দিতো, হয়তো আজ ও মান্টোর ভূত বসে এসব দোকানে অফসানা লেখে।
অনেকেই জনগণমন গানটি থেকে 'সিন্ধু' শব্দটি বদলের দাবী জানান। সিন্ধ প্রদেশ এখন পাকিস্তানে। যেমন হরপ্পা ও। বাদ দিয়ে দিন সিলেবাস থেকে তার ইতিহাস ও তবে? আগুন লাগিয়ে দিন ইশমত চুগতাই, মান্টো, ফৈয়জ অহমদ ফৈয়জে। ওরা কোন দেশের সম্পত্তি?
পাকিস্তানের সবকিছু মুছে ফেলতে চাই আমরা। ওরা ও হিন্দুস্থানের সব মুছে ফেলতে উদ্যোগী। ওই যে মুলতানি মাটি লাগান, ওই যে কসুরি মেথি দেন খাবার এ, ওগুলো সব কিন্তু পাকিস্তানে। মুলতান আর কসুর অঞ্চলের। আর জেনে রাখুন করাচি বেকারি আর সুইটস এখনো অন্তত এক ডজন আছে আমেদাবাদ, হায়দারাবাদ, দিল্লি। মান্টো আজ ও শাটার বন্ধ হলে ওই দোকানের ঠান্ডা মেঝেতে গিয়ে শোয়।
ওই যে পাঞ্জাব আর দিল্লিতে শিয়ালকোট, পিন্ড, বালুচী নামের হোটেলগুলো আর করাচি চিকেন, করাচি হালুয়া ইত্যাদি। ওগুলোতে র্যাডক্লিফ সাহেব লাইন টেনে দিতে কেন পারেন নি? পাকিস্তানি এক বন্দিকে রাজস্থানের জেলে পিটিয়ে মারা আমাদের কাছে দেশাত্মবোধক জয় এখন। গদ্দারের মৃত্যুর জয়োৎসব উদযাপন করতে রাস্তায় নেমে আসি আমরা।
এরকমই কোন এক উল্লাস মুহুর্তে অনেকগুলো নখ দাঁত বের করা মুখের মাঝে কোন আধপাগল অপরিচ্ছন্ন লম্বা-দাড়ি মানুষ দেখতে পেলে ওর কাছে যাবেন। নাম জিজ্ঞেস করবেন। যদি বলে "উপর দি গুড়গুড় দি আনেক্সে দি বেধিয়ানা", দু থাবড়া দিয়ে ফের জিজ্ঞেস করবেন। "টোবা টেক সিং" শুনতে পেলে তবে দেশের নাম জানতে চাইবেন। যদি দেশের নাম না বলতে পারে, ধরে নিতে হবে ও দেশদ্রোহী, শত্রুপক্ষ। পাকড়াও করবেন। সেনা ডাকবেন, কামান দাগবেন ওর দিকে।
এরকম এক সময়, ঠিক সূর্যোদয়ের আগে ভয়াবহ একটা আর্তনাদ করে দেখবেন সন্ত্রাসী মাটিতে মুখ থুবরে পড়ে আছে। তখন কাঁটাতারের পেছনে একদিকে দাঁড়িয়ে ভারতের উন্মাদেরা আর আরেকদিকে কাঁটাতারের পেছনে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের উন্মাদেরা।
দাঁতমুখ খিঁচিয়ে টানা জিন্দাবাদ- মুর্দাবাদ করছে দু দেশের লোক। নিজের দেশের মানুষকেই পিটিয়ে মারছে। মাঝখানে একটুকরো নামহীন জমিনের উপর মুখ থুবরে পড়ে আমাদের মতো কিছু "গদ্দার" তোবা টেক সিং। মান্টো কিছুটা দূরে বসে ঠান্ডা গোস্তদের দেখছে।
"উপর দি গুড়গুড় দি আনেক্সে দি বেধিয়ানা দি মুঙ্গ দি ডাল অফ দি পাকিস্তান এন্ড হিন্দুস্থান অফ দি দুর ফট্টে মুন"।
©----- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
No comments:
Post a Comment