| তব করুণারুণরাগে, নিদ্রিত ভারত জাগে |
#পঁচিশেবৈশাখ
--- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
'হে মোর দুর্ভাগা দেশ’- এই কয়েক লাইন খেরোখাতায় লিখে ছ'ফুট লম্বা কবি জোব্বা পরে, অস্থির পায়চারি করছে কবিত্বহীন নীলিমায়। টানা কিছু লোক নাকি হেঁটে চলেছে ঘরে ফিরবে বলে কিন্তু কেউ কিচ্ছু না করে ফের একবার তার সমস্ত গান সেই এক স্কেলে, এক হারমোনিয়ামে, এক সুরে, এক বই দেখে গাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এভাবে কি সে অমরত্ব লাভ করতে চেয়েছিল?
পাশের গ্রামের কালো হরিন চোখে কে বা কারা যেন এসিড ছুঁড়ে মেরেছে দলিত বলে। ছোট নদীর মাঝিকে কে যেন হুমকি দিয়ে গেছে। লালনের নৌকায় ভারত মাতা কি জয় লেখা বাধ্যতামূলক নাকি। না লিখলেই বুঝতে হবে সে পাকিস্তানকে ভালোবাসে৷ ওদিকে একের পর এক ধানের গোলা জ্বলছে গুজবের আগুনে। এই কি সভ্যতার সংকট তবে?
একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে গুরুদেব নিজের ইজিচেয়ারে বসলো।ঠিক যে সময় নিজের দেশের প্রতি রাগে অভিমানে রবিঠাকুরের মনে হচ্ছিল আত্মহত্যা করি, কে যেন হাড়জ্বালানো একগাল দাড়ি নিয়ে হেসে বলছে, মোক্সাহ্যালো, কি ভালো তো? ইতিউতি শিরোনাম ঢেকে দিতে চাইছে জাতীয়-নগ্নতা। সবটা পারছে কি? শিরোনামগুলো পড়ি।
'রাম নাম সত্য হে, সত্য হে' ধ্বনি উঠছে। ফেজটুপি পরা কয়েকজনের কাঁধে এক বৃদ্ধ শুয়ে। মেরঠে এক হিন্দু মারা গেছে, বাড়ির লোক আটকে আছে। বেরোতে পারছে না শেষকৃত্য করতে। পাড়ার মুসলিম প্রতিবেশীরা স্বসম্মানে শেষকৃত্য করলো, শ্বশান নিয়ে এলো।
মুসলমান আজিম প্রেমজির বাবার কাছে প্রস্তাব ছিল পাকিস্তান যাওয়ার। ওদের পরিবার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এ দেশেই ব্যবসা বানিজ্য করে যায়। প্রেমজিদের উইপ্রো ১,১২৫ কোটি দান করেছে৷ ওদিকে রতন টাটা বলে এক পারসি সংখ্যালঘু সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা ১৫০০ কোটি টাকা দান করবে করোনা প্রতিরোধে৷ হিন্দু আম্বানিরা ঠিক করেছে একটা হাসপাতাল বানাবে করোনার জন্যই স্রেফ। পারলে জী বিস্কুট কোম্পানি পাঁচ কোটি বিস্কুটের প্যাকেট বিনামূল্যে সরবরাহ করছে। আমূল ঠিক করেছে দরকার পরলে রাত দিন এক করে তারা কাজ করবে কিন্তু দুধের সরবরাহ স্তব্ধ হতে দেবে না দেশে৷
শাহরুখ খান একডজন এনজিওর একবছরের বাজেট সমান দান করলেন। নিজের অফিস খুলে দিলেন কোয়ারেন্টাইন সেন্টার বানানোর জন্য। অক্ষয় কুমার শিল্পপতি না কিন্তু এক কথায় ২৫ কোটি টাকা দান করে দিলেন। সলমান খান ঠিক করেছে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সাথে যুক্ত ২৫,০০০ ঠিকা শ্রমিকের সব দায়িত্ব নেবে।
টানা তিনদিন পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছে যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা তাদের বিনেপয়সাতে দুটো করে কলা আর জল দিচ্ছে এক ব্যবসায়ী। বিরাট হৃদয়ের ব্যাবসায়ী। ঠ্যালা গাড়িতে করে কলা বেচে হাইওয়েতে৷ অন্যদিকে টানা কিছু মানুষ ওদের খাবার জোগান দিচ্ছে। জল এগিয়ে দিচ্ছে।
এখন কি হিন্দু, মুসলিম, বাঙালি, মারোয়ারী, পাঠান ব্রাহ্মণ ভাবলে চলে? শেষমেশ তো সব্বাই ওই দেশ কা নমক খেয়েছি, সব্বাই তো সেই তিরঙ্গা- চরণে মাথা নত করেছি।
গুরুদেব আপনি আশ্বস্ত হোন। এই মানবপীড়নের মহামারী শেষে আমরা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসিক হিসেবে না ভারতীয় হিসেবেই বিজয়ী হবো। আমাদের শত্রুদের চিনে নেবো৷ স্রেফ রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীতে থাকতে হবে, প্রেমরসে থাকতে হবে, ঘৃণার ডোবাতে নয়৷ গোডসে, হিটলারে বিনাশ অবধারিত৷
কোরোনা সুযোগ দিলো, হাতে হাত ধরুন দেশের রোগ সেরে গেলে৷ ১৩০ কোটি এক হয়ে গেলে পাহাড় ও টলে যায়, সমুদ্র চিড়ে এগিয়ে যায় সেই শব্দ ব্রহ্ম -
তব করুণারুণরাগে নিদ্রিত ভারত জাগে,
তব চরণে নত মাথা।
জয় জয় জয় হে জয় রাজেশ্বর, ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।
©---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
No comments:
Post a Comment