| শুভ জন্মদিন লিটল মাস্টার ❤ |
---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
নভজোৎ সিং সিধু তখন পুরোদমে ভাষ্যকার। পৃথিবীকে শচীনের জনপ্রিয়তা বোঝাতে বলেছিলেন, ভারতে প্রধানমন্ত্রীকে ও একবার অন্তত কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় কিন্তু শচীন তেন্ডুলকারের দিকে একবার আঙুল ও যদি কেউ তোলে গোটে দেশে আগুন লেগে যাবে৷ ভারতে আবেগের আরেক নাম শচীন রমেশ তেন্ডুলকার।
ভারতবর্ষে ডজনখানেক ধর্মের মধ্যে একটি প্রধান ধর্ম ক্রিকেট আর তার দেবাদিদেব শচীন তেন্ডুলকার। এমন একটি নাম যা ১৩০ কোটি দেশবাসীকে এক করতে পারে। যে হাত জোড় করলে এক ওভারের ও কম সময় লাগে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ থামাতে।
মনে পড়ে ১৯৯৯ এর ইডেন গার্ডেন্স? ভারত বনাম পাকিস্তান। শোয়েব আখতারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে শচীন রান আউট হয়ে গেলে দর্শকদের ক্ষোভে খেলা বন্ধ করে দিতে হয়। পাবলিক পারলে আগুনে পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তান আর হাতের কাছে সেই শোয়েবকে। ওই এক লাখ মানুষকে থামাতে মাঠে সেই পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির লোকটাকেই আবেদন করতে হয়েছিল। ওর আবেদনে দর্শকেরা শান্ত হলে খেলা আবার শুরু হয়।
আপনি শচীনকে পছন্দ নাই করতে পারেন। কিন্তু গোটা স্টেডিয়াম যখন একসাথে মন্ত্রোচ্চারণের মতো শ....চীননন... শ...চীন বলতো আপনার গায়ে কাঁটা দিতো নিশ্চয়ই। লিটল মাস্টার যখনই দেশের হয়ে ব্যাট করতে নেমেছে আপনি সব ফেলে খেলা দেখতে বসেছেন৷ হাউ হাউ করে কেঁদেছেন যখন শেষবার ক্রিকেট-ভগবান মাঠ ছেড়েছে, শেষবারের মতো দেশের পতাকা গায়ে জড়িয়ে হাত নাড়িয়েছে।
শচীন সেই সুপারহিরোর নাম যে দশকের পর দশক ধরে জেতার সাহস জুগিয়ে গেছে গোটা ভারতকে। চাকরি চলে গেছে, পরীক্ষায় ফেল করেছে, বান্ধবী ছেড়ে গেছে, স্কুলের বার্ষিক রেসে লাস্ট হয়েছে, কিন্তু বাড়ি ফিরে শচীনের ওই দারুণ একটা ছয়, ওয়াসিম আক্রম, ইউনিস, অ্যালান ডোনাল্ডকে হেব্বি প্যাদানো দেখে সব ঠিক হয়ে গেছে। শচীন তো সেই Great Indian Dream যে কোটি কোটি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেগুলোকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল প্রথম ১১য় স্থান পাওয়ার, শচীন, সৌরভ, দ্রাবিড়, লক্ষ্মণ এর মতো দেশের নীল জার্সি গায়ে ময়দানে নামার৷ বাবার হাতে পায়ে ধরে ক্রিকেট কিট কেনা, মায়ের সঞ্চিত অর্থ নিয়ে প্রথম ক্রিকেট কোচিং, রাতের পর রাত শ্যাডো প্র্যাক্টিস - শচীনের পোস্টারগুলোই সাক্ষী সেই সমস্তকিছুর। ভারতের ঘরে ঘরে চেনা ছবি। নায়ক অবশ্য সব ছবিতেই এক। শচীন রমেশ তেন্ডুলকার।
একটা গোটা প্রজন্ম অন্ধের মতো ভগবানের কথাগুলো বেদবাক্য হিসেবে মেনে চলেছিল। ভগবান বলছে Boost is the secret of My Energy, ব্যাস মাকে রোজ বলা, হরলিক্স না, কমপ্ল্যান না, বুস্টই বেস্ট। এরপর ভগবান অ্যাকশন শু পরে মাঠে নামলো। বিজ্ঞাপনটা দেখে বুঝলাম শচীন হতে গেলে অ্যাকশন শু মাস্ট আর হাতে থাকতে হবে পেপসি। উইকেট নিই বা ছক্কা হাঁকাই, শান্ত থাকতে হবে, কারণ ইয়ে দিল মাংগে মোর!
এই শচীনকে দেখিয়েই তো অনেক বন্ধুর থেকে আলাদা করতে চেয়েছিল মা বাবা। শচীন হও বিনোদ কাম্বলি না। আমরা ও স্মার্ট কিনা, সঙ্গে সঙ্গে শচীন যে ক্লাস টেন পাশ সেটা মনে করিয়ে দিতাম, প্রশ্ন করতাম তবে কি আমরা ও সারাদিন খেলাধুলা করতে পারি? পড়াশোনা করে কবে কে শচীন তেন্ডুলকার হয়েছে!
তেন্ডুলকার বোধহয় আর কেউ হয়নি। হবে ও না। ওই যে হেলমেট খুলে আকাশের দিকে ব্যাট তোলা, প্রয়াত বাবাকে প্রতিটা সেঞ্চুরি উৎসর্গ করা, যতোই বড় খেলোয়াড় হয়ে যাক না কেন, বৃদ্ধ গুরু রমাকান্তের টিপস মন দিয়ে শোনা, শিবাজি পার্ক এ সামান্য ফ্ল্যাটে শিকড়, সমস্ত স্বাচ্ছন্দ্যে বড় বড় পাঁচতারা হোটেলে থাকলে ও মুম্বাইয়ে নিজের পাড়াকে মিস করা, রাস্তার ধারের ভড়া পাও পেলে গোগ্রাসে গেলা, মধ্যবিত্ত পরিবারের ছোট ছেলে থেকে বিশ্বক্রিকেটের অতিমানব হয়ে ওঠা - ওটাই তো ভারতের ১৩০ কোটির স্বপ্ন।
ওই গল্পটা শুনেই তো সারাদিনের ধকল, ব্যার্থতা, গ্লানি ভুলে ঘুমোতে যেত একটা গোটা দেশ। যে ফের একবার জিততে চায়, ঘুরে দাঁড়াতে চায়, ছেঁড়া কাথায় শুয়ে স্পর্ধা দেখায় উচ্চাভিলাষের। খোঁজ নিন, ওরা রোজ স্বপ্নে নিজেকে শচীন ভাবে। নীল জামা গায়ে, আবশ্যিক হেলমেট মাথায়, MRF এর ব্যাট হাতে ড্রেসিং রুম থেকে লম্বা করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাঠে ঢোকে। গমগম করছে এক লাখ মানুষ, কেউ পোস্টার হাতে, কেউ জাতীয় পতাকা - মন্ত্রোচ্চারণের মতো সবাই একসাথে চিৎকার করছে তালে তাল মিলিয়ে। শ....চীননন... শ...চীন। এটা ভারত। এখানে আবেগের আরেক নাম শচীন রমেশ তেন্ডুলকার।
©----- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
No comments:
Post a Comment