কবির কদর নেই জীবদ্দশায়, কবির কবর দেয়া হয় না।
থাকলে,এপিটাফ কদর দিত/কোন নিষিদ্ধ প্রেমিকার মতো।

mayukh speaks

My photo
kolkata, west bengal, India
A media professional and a wanderer by passion. Blogger and social observer. loves to watch world films and hear different music genre.

Sunday, October 15, 2017

ডাক্তার অসুর হলে মন্ডপে ভীড় বাড়ে

| ডাক্তার অসুর হলে মন্ডপে ভীড় বাড়ে |

---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

মহম্মদ আলী পার্ক মনে করেছে ডাক্তারই অসুর  হোক এবার থিম পুজোর। কথায় কথায় ডাক্তার পেটানো পাব্লিক হেব্বি খাবে। যেভাবে সরকার মনে করেছিল বিমুদ্রাকরণই দেশের সব সমস্যার সমাধান।

ভাবুন তো, সমস্ত ডাক্তার মৃত। আপনার শিরা, উপশিরা, ধমনীতে জমতে থাকা রাগ, দারুণ রাগ ফেটে পরেছে ডাক্তারদের উপর। আর একটাও ডাক্তার পরে নেই। ডাক্তারদের ডেথ সার্টিফিকেট লেখার ডাক্তার নেই। মৃত ঘোষনা করবার ডাক্তার নেই। রক্ত লাগা স্টেথোস্কোপ এদিক ওদিক, একটা দুটো ফ্রিতে পাওয়া কলম আর দলা পাকানো রাগ ছড়িয়ে আছে। হাসপাতালে পিকনিক করার ডাক্তার নেই, রোগী মৃত্যুতে বেদম ক্যালানো ডাক্তার বেঁচে নেই। থাকার মধ্যে স্টেথোস্কোপ। কম্পন অনুভূত হচ্ছেনা। গন শত্রু মৃত।

সময় আছে এখনো। আসুন মহম্মদ আলী পার্ক এবছর বয়কট করি।

আমার মা বাবা দুজনেই পেশায় চিকিৎসক। সরকারি হাসপাতালের জিপি। রোজ ৬০০ রোগী আসে, টিকিট কেটে ওপিডি-তে রোগ নিয়ে লাইনে দাঁড়ায়। কখনো রাগে ফেটে পরে। কখনো বাড়ির সব্জি নিয়ে আসে ভালোবেসে। ভগবান তবে মাটির কাছাকাছি।

আমি ছোটবেলায় এসব দেখেছি। ছোটবেলার অনেকটা সময় আমি সোনারপুর হাসপাতাল কোয়ার্টার এ কাটিয়েছি। নার্স, আয়া মাসিমাদের মাঝে।

ছোটবেলায় স্কুলের বন্ধুরা ভাবতো ও বলাবলি করতো যে আমাদের নাকি বহু গাড়ি, সাত মহলা বাংলো বাড়ি, ৭৭ ডজন মায়ের শাড়ি ও আমার এক আলমারি খেলনা আছে। কারন আমার মা বাবা দুজন ডাক্তার। ডাক্তার দের এসব থাকে। তারা ওষুধ এর কাটমানি নেয়, অপারেশন করে কিডনি বের করে নেয় তবে তারা ভগবান। আমার লজ্জা লাগতো আর রাগ ও। বাস্তব এ এর একটা ও দেখিনি। থাকার মধ্যে সাকুল্যে একটা অল্টো গাড়ি, ভালো ভাবে থাকার জন্য জরুরি মধ্যবিত্ত যা কিছু। উচ্চাশা ছিল।

উচ্চাশা থাকা কি অপরাধযোগ্য? একজন ডাক্তার যে ১০ বছরভর মাথা গুজে শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, তার উপর আরো দক্ষ হওয়ার শিক্ষা, ক্লিনিক এ রোগী দেখা শেখে, তার কি শখ থাকতে পারেনা রোগী দেখে একটি টয়োটা কেনার?

একটি ফটকায় ব্যাবসা করা দালাল, ড্রেন তৈরির টাকা থেকে কাটমানি খাওয়া কাউন্সিলর ও স্কোরপিও চড়ে। আর ডাক্তার জ্যান্ত লোকের কল কব্জার ভার নিয়েছে।

এরপর এক দক্ষ এমবিএ পাশ কিছু ওষুধ কোম্পানি তাকে মার্সিডিজ এর স্বপ্ন দেখায়। কিচ্ছুটি করতে হবেনা। স্রেফ বিশেষ ট্যাবলেটটা লিখে যেতে হবে বা রোগীকে ভয় পাইয়ে টেস্ট করতে পাঠাতে হবে। নিদেনপক্ষে একটা আইসিইউ বেড এ পাঠানো। ডাক্তার এর কথায় সব হয়। ডাক্তার ভগবান।

কিন্তু ভগবানকে যেরকম মানুষ এর মত হাগু করতে দেখলে, চুমু খেতে দেখলে প্রবল আশাহত হয় ভক্ত, সেভাবেই হাসপাতালের কাঁচগুলোতে আঁচড়ে পরে রাগ। জমি বেচে, ফিক্সড ডিপোজিট বন্ধক রেখে চিকিৎসা করা মানুষ এর রাগ।

রাতের ঘুম এ মৃত রোগীর মুখ, হাত ক্রমাগত ধুলেও রক্ত, ঘেমো পেশেন্ট পার্টির কান্না, কোলে বাচ্চা নিয়ে বউ এর অশিক্ষা ভরা অভিশাপ। ডাক্তার বাবুরা নিশ্চিত এ সব দেখেন। আসলে নিজেরাও স্বীকার করেন না।

তাই হয়তো মদের দোকান এর ব্যাবসা থেকে কিছুটা আলাদা চিকিৎসা ব্যাবসা আর যে চিকিৎসক এই ব্যবসা তে সিদ্ধহস্ত তিনি চিকিৎসক নন চিকিৎসা শিল্পপতি। মৃত মানুষ কে ঠিক কতটা দোজ দিলে নড়ে চড়ে উঠবে ভিজিটিং আওয়ার এ, কতদিনের প্যাকেজ এ কাকে রাখা যাবে এরা সব জানে। জানতে শিখিয়েছে ব্যাবস্থা।

আসলে গলদটা বোধহয় এদের না। চিকিৎসক বা চিকিৎসা শিল্পপতি না হতে পারা লোকেদের। আমাদের। আমরাই কাঠামো তৈরি করেছি এমন যেখানে বিচারক আসে এম্বাসেডর চড়ে আর উকিল আসে মার্সিডিজ এ। মুহুরির নিদেনপক্ষে একটি বোলেরো। এবার এই বিচারক বিবাহিত,  বউ প্রতিরাতে আদর করার সময় উদাহরণ দেয় কোন উকিল কি কিনলো তার, বিচার ধুয়ে জজ সাহেব কে টেবিল এর তলায় গাড়ি কেনার টাকা টা নিতেই হয়।

যে মানুষ সারা জীবন প্র‍্যাক্টিস না করে মেডিকাল কলেজ এর প্রফেসর হয়ে থেকে গেলেন, তার মাইনে ছাত্রের গাড়ির তেল এর খরচা। গুটখা কোম্পানি কে হাসপাতাল তৈরি করার সুযোগ রাষ্ট্র দিয়েছে। আমরা সুবিধা করে দিচ্ছি। আর ডাক্তার দের মাইনে করা একজিকিউটিভ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বার এ। যেখানে পান এ পিক ফুলের টব এ ফেলে মালিক বাহাদুর বলে:
"কি ছিড়ছো? হচ্চে না ডাক্তার। কয়েকটা ভেন্টিলেটর দাও।"

মা বাবা চিকিৎসা শিল্পপতি হতে পারেনি। রোজ বাড়ি এসে মা রান্না করে। আমরা ডাল ভাত পাতলা মাছ খাই। আমার পেটের অসুখ, আলসার, অম্বল। মা ডায়াবেটিক, বাবার প্রেসার। যেরকম অন্যান্য বাড়িতে হয় আরকি। চিকিৎসা শিল্পপতি দের ও পেটের অসুখ, আলসার, অম্বল হয়। ডাল ভাত, পাতলা ঝোল খায়। কিন্তু বিভ্রম এ কখনো ডাল এ বাজে ওষুধ, কিডনি সেদ্ধ, পাতলা ঝোলে রক্ত দেখতে পায় যদি? সে বড় কঠিন অসুখ।

যে সমস্ত চিকিৎসক আজ ও জীবিত আর রোজ রোগ সারিয়ে তোলার তাগিদে হাসপাতালে ছোটেন, তারা শহরে রোগীদের কাছ থেকে খুশি মনে পারিশ্রমিক ও শ্রদ্ধা পান, গ্রাম এর সরকারি হাসপাতালে শ্রদ্ধা, অন্ধ বিশ্বাস আর বাড়ির সব্জি।

এদের দেখে আজ ও অনেকের গলার কাছে দলা পাকানো কি যেন হয়।

আমরা কেউ সৎ নই। যতটা থাকা যায় বিবেক এর কাছে আরকি।তবে কেউ যদি লাশ নিয়ে ব্যবসা বা বিশ্বাস নিয়ে মুরগি বানানোর পচা খেলায় মেতে ওঠে, হাসপাতালের বোর্ড পাল্টে "ক্যাওড়াতলা" লিখতে হয় বইকি। জনগনতান্ত্রিক বিপ্লব এটাই কিন্তু ডাক্তারকে যে সমাজ অসুর বানায়? সেখানে অশ্বিনের শারদপ্রাতে শুভবুদ্ধি উদয় করাবে কে?

©---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

No comments:

Post a Comment