| বোম্বাই এর বোম্বেটেদের যম, কর্কটরোগের কাছে পরাজিত |
#বংযাত্রীরবম্বেডায়েরি
---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
পুলিশের প্রতি ভক্তি যে কয়েকজন কে দেখে আসে, তাদের মধ্যে এই ভদ্রলোক থেকে যাবেন। ইনিই বোধহয় সত্যিকারের ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতি আর এদিকে চারশো ওদিকে চারশোর অধিকারী ছিলেন। একটা ঢাই কিলো কা হাত যা মুম্বাইকে সুরক্ষিত রাখতো।
যে মহিলাটি আজ রাতে মেরিন ড্রাইভে রাত দুটোর সময় বসে তার তিন বন্ধুর সাথে গল্প করছে, যে ছেলেটি মধ্যরাতে বাড়ি ফিরছে, যে তারকা একের পর এক হিট ছবি করছে দুবাই বা পাকিস্থানে কোটি টাকার সালামি না পাঠিয়ে, যে মুম্বাই শহরে আর গ্যাং ওয়ার দেখা যাচ্ছে না, যে মায়ার শহর নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাচ্ছে আর একটাও সন্ত্রাসবাদী হামলার সাক্ষী না হয়ে, তার কিছুটা কৃতিত্ব এই ঢাই কিলো কা হাতের।
কলকাতা হোক বা মুম্বাই, ভালো দেখতে পুলিশমানুষকে দেখলে মেয়েরা এমনিতেই একটু প্রেমে পরে। তবে পুলিশের বউ সচারচর হতে চায় না। হিমাংশু রায়ের প্রেমে ও পরতো, বিয়ের প্রস্তাব ও আসতো।
লালমোহন গাঙ্গুলী হিমাংশু রায়কে দেখলে নিশ্চই ওর ট্রাইসেপ্স, বাইসেপ্স, কোয়াড্রাসেপ্স ছুঁয়ে দেখে বলতো "ওয়ার্ক অব আর্ট মশাই"। ফেলুদা হয়তো এই সুপারকপকে দেখেই বলতো, চিনে নিন এনাকে। ইনি 'বোম্বাই এর বোম্বেটে' দের যম।
বম্বে থাকাকালীন বলিউড স্টুডিও পাড়ার ফিসফাস, দুপুরের অলস গসিপ শুনতে হতো মাঝেমধ্যে। একথা সেকথায় শুনতাম হিমাংশু রায়ের নাম। মেকআপ দাদা হোক বা প্রোডাকশন ম্যানেজার। হিরো বলে সম্বোধন করতো রায়কে আড়ালে সবাই। বলা হত জামা খুলে সলমানের মত দাঁড়ালে নাকি অনেকেরই ঈর্ষার কারণ হবে। সাথে আবার অমিতাভ বচ্চনের মত ব্যারিটোন আর জন্মসূত্রে রাজপুত হওয়ায় সেই পুরুষ্টু গোঁফ।
ওর নাম আসবেই স্টারেদের অন্তরমহলের আলোচনায়। কারোকে দাউদের কোন চ্যালা হুমকি দিয়েছে বা কারোর বাংলোর সামনে রোজ রাতে কেউ একটা এসিডের বোতল রেখে যায়, সবার প্রথম কল যাবে হিমাংশু রায়ের কাছে। বলা হয়, নায়কেরা যতটা হিরোইজম দেখায় ছবিতে, বাস্তবে অনেকেই নাকি ওই বেনারসের বিশ্বশ্রীর মত। এক হুমকি চিঠিতেই ফুঁস! তখন রায় সাহাবকে ফোন যায় ভারতকাঁপানো তারকার।
দাউদ আর ছোটা সাকিলের দাপাদাপি পরবর্তী সময় মুম্বাই শহরকে যারা গোটা দেশের জন্য বাসযোগ্য বানিয়ে তুলেছিল, বেছে বেছে কুঁচো বম্বেটেদের ধমকিয়ে বা রাঘব বোয়ালদের এনকাউন্টার করে, তাদের মধ্যে এই হিমাংশু অন্যতম। এই হিমাংশু রায় সেই লোকটি যার জন্য আজ ও মুম্বাই মহিলাদের জন্য অন্যতম নিরাপদ এক শহর। চোখ বন্ধ করে যে শহরে মেয়েরা রাত দুটোতে ও একলা ঘুরে বেড়াতে পারে, সমুদ্রের পারে গল্প করতে পারে, কারন হিমাংশু রায় ও টিম ওদের নিরাপত্তা দিচ্ছে। ঢাই কিলো কা হাত আগলে রাখছে। এর গল্প না বললে বংযাত্রীর বম্বে ডাইরি অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
মালেগাঁও ব্লাস্ট, দাউদের ভাইয়ের গ্রেফতারি, আইপিএল স্পট ফিক্সিং মামলা থেকে সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দে হত্যা মামলার মতো হাই প্রোফাইল মামলায় অন্যতম তদন্তকারী ছিলেন তিনি। কোন অহংকার নেই। সাংবাদিকেরা যখনই ফোন করতো, নিজে ফোন তুলে পুরোটা শুনতেন, এক দু লাইন লিড দিতেন তারপর কেটে দিতেন। কখনো মনে হলে রিং ব্যাক করে আরো একদুই লাইন বাড়তি তথ্য। আপনি পুলিশ বিট করুন বা না করুন।
মুম্বাই এ খুব বেশীদিন তারকা পুলিশ থাকলে যা হয়, তাই হয়েছিল এর। অনেকের চক্ষুশূল হয়ে গেছিলেন, তারওপর আন্ডারওয়ার্ল্ড এর প্রেশার তো ছিলই। সরে যেতে হয়েছিল। একটা গুরুত্বহীন পজিশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
রোজ শরীর চর্চা করতেন। নামি দামি জিম ট্রেনারের সাথে গল্প করতেন। পছন্দ করতেন বোম্বাই এর আলোকোজ্জ্বল সন্ধেগুলো, সমুদ্রঘেষা মালাবার হিলের বাড়ি থেকে।
২০১৬ সালে কর্কটরোগ ধরা পরে। বড্ড দেরি করে।এরপর একটু একটু করে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন। কেমো নিতে হচ্ছিল, বিদেশে ও গেছিলেন। ঢাই কিলো কা হাত ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছিল। ঘনিষ্ঠ মহলে বলতেন ও, আর পারছিনা এই যন্ত্রণা সহ্য করতে। অসহ্য যন্ত্রণা হত। কর্কটরোগ তখন মস্তিষ্কে হানা দিয়েছে।
দুবছর মেডিকেল লিভ নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। এই দুবছর কারোর সাথে খুব একটা যোগাযোগ রাখেন নি। ছবিতো নয়ই।
সার্ভিস রিভলবার থেকে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করলেন আজ সকালে মহারাষ্ট্রের সন্ত্রাস বিরোধী স্কোয়াড (ATS)-এর প্রাক্তন প্রধান, ২৬/১১ এর চক্রী ডেভিড কোলেম্যান হেডলিকে চিহ্নিতকরণের, কাসবকে ফাঁসিতে ঝোলানোর কেসফাইল তৈরি করা অফিসার হিমাংশু রায়। বোম্বাই এর বোম্বেটেদের বশে এনেছিলেন, কর্কটরোগটাকে পারলেন না। যেভাবে অনেক সুপারহিরো পারে না জীর্ণ হয়ে বেঁচে থাকতে। রেসের ঘোড়ারা পারে না পঙ্গু হয়ে পরে থাকতে। সুপারকপেরা চায়না অন্যের সহানুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকতে।
হিমাংশু রায়ের প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা ওর না বলা কথাটা রেখেছে। এই হাট্টা কাট্টা, মাংসপেশী সমেত চেহারাটাই সমস্ত জায়গায় থেকে যাবে। আগুনে পুড়ে যাক এক জরাজীর্ণ, কর্কটরোগে আক্রান্ত, শীর্ণকায় মধ্যবয়সী। ইতিহাস গল্প শোনাবে এক বাস্তবের ঢাই কিলো কা হাতের যা দেখে দাউদের ও পিলে চমকে যেত।
©--- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
No comments:
Post a Comment