| দেহাতি কিংবা গাঁইয়া |
----- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
এগিয়ে রাখার ধারকবাহক ও চাড্ডিকূল সফল। এরা বাঙালিকে চুলকে চুলকে তার দুর্গন্ধযুক্ত, পচা,গলা, পুঁজ ধরা সাম্প্রদায়িক, সামন্ততান্ত্রিক, অভিজাত, বর্ণবিদ্বেষী,উন্নাসিক চেহারার যে ককটেল তা ফের বের করে আনতে পেরেছে। যে দগদগে ঘাতে মলম লাগাতে কালঘাম ছুটে গেছিল রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথের, তা আবার প্রকাশ্যে। বিশ্বভারতী সমাবর্তনে যথার্থই সিটি মারা ও জয় শ্রী রাম ধ্বনি।
আমরা যারা শহুরে শিক্ষিত বাঙালি বলি নিজেদের, আমরা যারা আনন্দবাজারে আছি আবার আনাকারিনাতে ও, আমরা যারা কুঁচকি চুলকোতে চুলকোতে সিংগল মল্ট হাতে কলকাতার ল্যান্ডস্কেপ দেখি বৃষ্টিতে আর পাঁচতারায় বাটি চচ্চড়ি খাই ফি হপ্তা, তাদের খুব পছন্দের দুটো শব্দ গাঁইয়া আর দেহাতি। এটা মূলত বলা হয় নিজের শ্রেণী পার্থক্য বোঝাতে। এতে কোন বাঙালিয়ানা নেই। আছে ব্রাহ্মণ্যবাদের গা ঘিন ঘিনে হ্যাংওভার।
গাঁইয়া মফস্বলের বাংলাভাষী মানুষ যারা জ্যালজ্যালে শাড়ি পড়ে বাসে উঠবে, বমি করবে, ফুটপাথের জামা কিনবে, বিপত্তারিনীর লাল সুতো বাঁধবে। গলায় কালো কার, শাঁখের আংটি, প্লাস্টিকের চূড়ি, ঝিনুকের হার, নকল মুক্তোর হেয়ার ব্যান্ড থাকবে। চড়া মেকআপ করে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আইসক্রিম খাবে। এদের আদবকায়দা নেই, সল্টলেকে ফ্ল্যাট নেই, বোসের স্পিকার নেই, সান ফ্রান্সিসকোর ভালোদাদু নেই, মননে শঙ্খ ঘোষ নেই, চেতনায় জাঁ পল সার্ত্রে নেই।
দেহাতি হলো বিহার বা ইউপির হিন্দিভাষী মানুষ যারা বহু দশক আগে কলকাতায় চলে এসেছিল খেটে খাবে বলে। যারা আমার আপনার মতই বাংলা বলে ও বোঝে। যারা ছটপুজো মানে বোঝে ভক্তি আর দুর্গাপূজো মানে উৎসব। যারা সাতমহলার ম্যাডামজীকে সমঝে চলে আর হাফপ্যান্ট বাজার করতে যাওয়া সাহাবকে সেলাম ঠোকে। এরা লুঙি পড়ে, পানের পিক ফেলে, হাত রিক্সা চালায়, মুটে মজদুরি করে, বন্ধ মিলের সামনে ঘুগনি বেচে, সামনে দিয়ে আঁচল ফেলে কাপড় পড়ে, ধোপা,ইস্তিরি, ম্যাথর- যেকোন কায়িক শ্রমের কাজ হাসিমুখে করে। নস্টালজিয়া বলতে বোঝে দাঁড়ভাংগা!
এই গাঁইয়া এবং দেহাতি বাদে ও বাঙালি খোট্টা, মাওড়া, উড়ে, লেড়ে, পাঁইয়া, চিংকি, আসামি, কাটার বাচ্চা সহ একাধিক বিশেষণে ভূষিত করে অন্য প্রদেশ, অন্য শ্রেণী বা অন্য ধর্মের মানুষদের। চন্দ্রবিন্দুর কথায় এরপর "নন-কমিউনাল দেওয়াল লেখে ক্যালকাটা টু হাওড়া"। প্রশ্ন তুললে বলে ওসব খিল্লি করে বলা। নাথিং সিরিয়াস!
আজ ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী বাংলাভাষী মুসলিম হয়। তাঁকে বাঙালি বলা হয় না। মুসলিম আবার বাঙালি নাকি? বাঙালি তো শাঁখা পলা সিঁদুর। ধুতি আর পৈতে। ওতে রেজাউল, শাহিদা, সাবরিনাদের জায়গা কোথায়?
নিজেকে শেষ ভিক্টোরিয়ান বাঙালি ভাবা, সংস্কৃতি-শিক্ষা দিক্ষায় বাংলা শাধা কিছু কুয়োর হতাশাগ্রস্থ ব্যাঙ এক ভয়ংকর খেলায় নেমেছে। এরা বাঙালি বলতে একটা শ্রেণী বোঝানোর চেষ্টা করছে যারা কলকাতাবাসী, ইংলিশ মিডিয়ামে শিক্ষিত, ভালো খেয়েছে, ভালো পড়েছে, বিদেশী চকোলেট উপহার পেয়েছে, নিউ মার্কেটের সুতির জামা কিনেছে, কাজের লোককে ছোটবেলা থেকে চাকর আর Domestic Helpকে ঝি বলেছে।
এই "বাঙালি"দের শেখানো হয়েছে বাড়িতে কিছু চুরি গেলে সব কাজের লোককে সন্দেহ করতে হয়। বিহারি হলে তো নির্ঘাত চোর। পিটিয়ে ও দেওয়া যায়। এদের পড়ানো হয়েছে সব মুসলিমরা বড্ড নোংরা হয়। এদের বলা হয়েছে মাওড়া মানেই প্রবল ধনী আর ব্যবসাদার। ব্যবসা খারাপ। সাহা রা ব্যাবসা করে। গু এর থেকে টাকা তোলে। এদের বেসিক নলেজে পই পই করে মুখস্থ করানো হয়েছে- কুন্ডু, মন্ডল, দাস মানে শিডিউল ক্লাস। মানে ওই দেহাতি বা গাঁইয়া।
আজ যারা দেহাতিদের ঘেন্না করতে শেখাচ্ছে, মিলিয়ে নেবেন কাল তারাই বলবে কাঁটার বাচ্চাদের জন্যই যত সমস্যা। পরশু দেখবেন SC/ST নরকের কীট বলছে এরাই। সতর্ক থাকুন। এরা আজ অবধি যত গুলো বিপ্লব হয়েছে এ বাংলায়, তার হোমে ও আসেনি, যজ্ঞতেও আসেনি। কাঠি করার কাজে, ঘোলা জলে মাছ ধরার কাজে এসেছে।
এ বাংলা যতটা চক্রবর্তী, ভট্টাচার্য, বন্দোপাধ্যায়ের ঠিক ততটাই ডেরোজিও, টেরেসা, ও'ব্রায়েন, হাকিম, ঝা, পান্ডে, নেওটিয়া, গোয়েংকা, কানোরিয়া, সাহু, মন্ডল, ওঁড়াও, রসিদ খানের। দশকের পর দশক ধরে বাংলায় যারা বসবাস করছে, যারা বাংলাকে ভালোবেসে বা কাজের তাগিদে পরে থাকছে এ মাটিতে তারা ও সমান বাঙালি। আমার বিশ্বাস তারাও রুখে দেবে হিন্দুস্থানে আগ্রাসন।
আভিজাত্য সম্পন্ন নাকউঁচু উন্নাসিক বাঙালির মমতা বন্দোপাধ্যায়কেও মেনে নিতে আপত্তি হয়েছিল। যেভাবে চাঁদ সওদাগর চ্যাং মুরি কানি বলেছিল মনসাকে। বামপন্থীদের হামেশাই বলা হয় ছোটলোক। এলিটিস্ট হওয়া আর ভেতো বাঙালি হওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। লড়াইটা মাছ ভাতেরই।সহজ হিসেব। কিছু লোক গো-বলয় থেকে এসে রাজমা আর সোয়াবিন গেলানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের রুখে দিতে প্রস্তুত বাংলায় বসবাসকারী মানুষ। সব মানুষ।
সামনে দারুন লড়াই। শুনেছি দেহাতিদের কিছু থাকুক না থাকুক গায়ে গতরে খাটার জোর আছে, হাতুড়ি কাস্তে ধরার শক্ত হাত আছে। বিপ্লবে শেষ অবধি ওটাই প্রয়োজন হয়। গ্র্যান্ড হোটেলে 'পল্লী গ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা বর্ণন' তো রোজই উত্তর সম্পাদকীয়তে হয়। বাংলার জনসংখ্যার যা সাকুল্যে ১০%। বাকিটা ওই দেহাতি বা গাঁইয়া যাদের খুঁচিয়ে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হয়। আপনারা বলেন Anarchy।
©----- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
No comments:
Post a Comment