| এলফিন্সটন ফুটব্রিজ ও ২২জন নিশিযাত্রী |
#বংযাত্রীরবম্বেডায়েরি
----- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
এখন বেশ রাত। শেষ ট্রেন ১.৩০ এ। তারপর কোন ট্রেন নেই। সব যাত্রী বাড়ি ফেরার কিছু আগের রাতজাগা কোন এক স্টেশন ঘুমোতে যাবে এবার। এটা এলফিন্সটন স্টেশন। এখানে নাকি স্মৃতিরা ছায়ামানুষ হয়ে ঘুরে বেড়ায়। রাত কাটায় ফুটব্রিজ, প্ল্যাটফর্ম এ।
এটা এলফিন্সটন স্টেশন এর সেই ফুটব্রিজ। মনে পরছে? যেখানে লাশের পিঠে লাশ চাপা পড়ে ছিল। এর মাথা ওর পায়ে পিষে গেছিল। শেষ মুহূর্ত অবধি বাঁচার চেষ্টা করার পর গ্রিল থেকে ঝুলতে থাকা সামান্য নিশ্বাস খোঁজা মৃতদেহ ছিল।
ওদিন আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল ২২ জন ফুটব্রিজের দুধারের ফাইবাবের বেষ্টনী ভেঙে ফেলার। হাওয়া আসলে সব হয়তো বদলে দিত। আর একটু কম ভীড় হলে হয়তো অনেকে অফিস যেত। কিছুজন বাড়ি ফিরতো, বাকিরা ফের আপিস যাওয়ার জন্য তৈরি হতো, জামা ইস্তিরি করতো, পছন্দের টিভি সিরিয়াল দেখে ঘুমিয়ে পরতো।
সেদিন সকাল ১০.৪০ অব্দি এদের নাম ছিল। ধর্ম ছিল, জাত ছিল, গোত্র ছিল। এলফিন্সটন থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্য ছিল। পদপিষ্ট হওয়ার পর থেকে এদের পরিচয় সংখ্যা দিয়ে।১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯,১০,১১,১২,১৩,১৪,১৫,১৬,১৭,১৮,১৯,২০,২১,২২।
এক মাস পরে ফুটব্রিজে আর কোন দলা পাকানো কান্না নেই, রক্তের ছাপ নেই, চুড়ি ভাঙার শব্দ নেই, নিউজ চ্যানেলের বুম নেই, উঁকিঝুঁকি, নেই নেই নেই। এটাই মুম্বাই স্পিরিট। পিছনে ফিরে তাকানো নয়, স্মৃতি স্মারক বানিয়ে হাহুতাস নয়। আরো দৃঢ় প্রত্যয়ে দৌড় দৌড় দৌড়। এখানে কোন মৃত্যু নেই আর।
থাকার মধ্যে রোজ রাতে শেষ ট্রেনের চলে যাওয়ার পরে নিঝুম স্টেশনে একসাথে ফের জড়ো হওয়া। একে ওকে দেখে সামান্য সৌজন্য বিনিময়, জিজ্ঞেস করা কোন ট্রেন কত লেট, কোন স্টেশনে কে নামবে, অযথা কেউ দরজা আটকে দাঁড়িয়ে নেই তো? কোন অফিস যেতে হলে কোন ফুটব্রিজ নেওয়া যায়, শহরের তাপমান কত।
রোজ রাতে ঠিক একভাবে একই সময় একই ফুটব্রিজে ২২জন নিশিযাত্রী খোশগল্প করে, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, এ প্ল্যাটফর্ম ও প্ল্যাটফর্ম কাতর ভাবে খোঁজে নিজের কারো কে যদি দেখতে পাওয়া যায়। শেষে কিচ্ছু না দেখতে পেয়ে, কাউকে না ছুঁতে পেরে ফুটব্রিজে বসে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে। ভোররাতে আর্তনাদ শোনা যায় না। সকাল হলে সেই চোখের জলও ঝেড়ে সাফ করে দেয় রেল, রাষ্ট্র, রাজনীতি, উন্নতশীল সভ্যতা।
সকাল হলে এসব গল্প বলা যাবে না। তখন বড্ড কাজের চাপ, দৌড়ে ট্রেন ধরার চাপ, পেছনের লোক কে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেওয়ার চাপ, ভীষণ বৃষ্টিতে ফুটব্রিজে সামান্য আশ্রয় নেওয়ার চাপ।
সব ভূতের গল্প অশরীরী নয়। কিছু ভূতের গল্প করুন অতীত স্মৃতির ও বটে। বংযাত্রীর বম্বে ডায়েরিতে এখনো দগদগে।
©----- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
No comments:
Post a Comment