| দাঁত অচ্ছে হে |
--- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
#বংযাত্রীরবম্বেডায়েরি
দাঁত অনেকটা অফিসের নিঃশব্দ দক্ষ কর্মীটির মত। ঠিক সময়ে আসে, টিফিনবাক্স নিয়ে ক্যান্টিনে চলে যায়, নো ননসেন্স, নির্দিষ্ট কাজ শেষ করে বাড়ি চলে যাওয়ার মত। টুঁ শব্দ থাকে না। সচারচর সাতদিনের ছুটি নিয়ে পুরী ঘুরতে না গেলে বা অসুস্থ হয়ে বাড়ি বসে না গেলে, বোঝা যায় না তার গুরুত্ব।
বাঙালি চোঁয়া ঢেকুর আর অম্বলজনিত অসুখ নিয়ে এতটাই ব্যাস্ত থাকে আজীবন যে ওই দাঁতকে আর যত্ন বা প্রমোশন দেওয়া হয়না। যেমন সব চেয়ে হাঁই হাঁই করে যে কর্মীটি, বসেদের সব কথায় ইয়েস স্যার বলে যে কর্মীটি, ফোঁপরদালালি আর একে ওকে কাঠি করে ঘুরে বেড়ায় যে, সে ওই চোঁয়া ঢেকুর আর অম্বলের মত। যতক্ষণ আছে, যেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আসলে হজমিগুলি আর ইনোতেই দু মিনিটে দমন।
দাঁত যে ব্যাথা দেয় তা দমন করার ক্ষমতা মধ্যবিত্তের নেই। সে ব্যাথা অনেকটা নষ্ট হতে থাকা দাম্পত্যের মত। ভিতর থেকে ক্ষয় হচ্ছে দীর্ঘকাল, জীবাণু ও ছিল, কিন্তু যতক্ষণ না ফুঁলে ঢোল হচ্ছে, অমানুষিক ব্যাথা হচ্ছে, থেকে যেতে হয়। উপড়ে তো দেওয়াই যায় যখন তখন।
এখন আর উপড়ে ফেলতে নেই। রুট ক্যানাল চিকিৎসার মাধ্যমে দাঁত না ফেলে দাঁতের ব্যাথা সম্পূর্ণ কমিয়ে দাঁতকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সম্পর্কচ্ছেদের পর ফের দিব্বি এক সাথে কফি শপে কথা, চাপা দোষারোপ শেষে একসাথে আগের মত থাকার মত।
আমার একটি মোলার টুথ বহুদিন ধরে জ্বালাছিল। সাথে অমানুষিক ব্যাথা। তো আমিও রুট ক্যানাল ধরেই শান্তি পথ খুঁজছি। শীতকাল এসে গেছে, দাঁতের গোঁড়ায় হু হু যন্ত্রণার অনুশোচনা থেকে যাবে নয়তো।
বম্বের ডাক্তারদের নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, এরা সবাই পেশাদারী বিপণনী সংস্থার সাহায্য নেন পশার বাড়াতে। অর্থাৎ যিনি রিয়েল ট্যালেন্ট তিনিও বিজ্ঞাপনে সদা হাস্য, যিনি ফটকাবাজি তিনি ও। Yardstick অগত্যা হতে হয় নামের নিচের ল্যাজ। বিডিএস এর পর আর কি কি আয়ত্ত করেছেন, কোন দেশ থেকে, কিসে ইত্যাদি। এতে মানসিক শান্তি পায় দন্তধারী।
আমিও এধরনের এক প্রাজ্ঞজনের কাছে গেলাম। শুনলাম রুট ক্যানাল ছাড়া গতি নেই আর সে পথ ধরতে হলে লাগবে দশ সহস্র মুদ্রা। ক্ষত গভীর, বেড়ে খেললে সব দাঁতে ছড়িয়ে পরবে, মারক লাগবে, ঝড়ে গাছ পরে যাওয়ার মত সব একে একে শেষ হয়ে যাবে। স্নায়ু ও রক্তবাহী নলি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মাংসকষা বদলে যাবে আজীবন গলা ভাতে, আনাড়ি খোঁচাখুঁচি করলে ব্রেন ও ড্যামেজ হতে পারে বা সুষুম্নাকান্ড। তারপর আমৃত্যু দাঁতে আর দাঁতে থাকো আলু ভাতে।
দাদা গো আমি বাঁচতে চাই। রইলো দশ সহস্র মুদ্রা। লেগে পরুন। আমিও রাজি হলাম। এক রাশ আপসোস সহ। ডেন্টালে চান্স পেয়ে ও ডেন্টিস্ট না হওয়ার আপসোস। আজীবন দাঁতের পাটি আর মুখের গন্ধ মেরামত ছেড়ে চ্যানেলের বুম আর ব্রেকিং নিউজের ধুম নিয়ে মেতে ছিলাম, দাঁত ব্যাথা হলে ক্লোভ ওয়েল আর সেন্সোডাইন। এর বাইরে যে কিছু হয় তা ভাবতেম নি।
মধ্যবিত্ত মানুষ আমরা। দাঁত মাজার ৫০ টাকার পেস্ট ও কিছু দিন বেশি চালাতে একদম চেপেচুপে ফোল্ড করে, শেষ অবধি ব্যাবহার করি। ব্রাশ ও তাই। ব্রাশ তো তারপরও বেঁচে থাকে জুতো বা বেসিন পরিষ্কার করতে।
দশ সহস্র মুদ্রা খরচাই যখন হচ্ছে, আশা করেছিলাম মারকাটারি কোন ঘটনা ঘটবে, প্রচুর রক্তপাত, ডাক্তারবাবুর অস্থির হয়ে পরা ইত্যাদি। সিনেমাতে যেরকম হয়। লে হালুয়া এখানে লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া মারলো, অত্যাধুনিক যন্ত্র দিয়ে কিসব স্মার্টলি করলো, কিছু খোঁচাখুঁচি আর মাল মশলা পুশ করা। ব্যাস। এ ভাবে তিন দিন। শেষে দশ সহস্র মুদ্রা ব্যায়ের স্মৃতিস্বরূপ এক ধরনের কৃত্তিম মুকুট পড়ানো। এ যেন সেই হাড়ানো পদক যা এক সময় বিয়ার বোতল খুলে ফেলতো, দামড়া ঠ্যাং চিবিয়ে ছাতু করে দিত, চুইংগামের সাথে সহবাস করতো।
ডাক্তার বাবু দাঁতগুলো জরিপ করতে করতে বললেন, আপকে বাকি দাঁত আচ্ছে হে। অর্থাৎ ওই একটাই হারামজাদা ছিল। বাকি সব অচ্ছে হে। বউদের মত। যত্নবান না হতে পারলেও অভিযোগ করেনা, খারাপ লাগা ফাঁকফোকরে আটকে থাকলেও বিদ্রোহ করে না। ময়লা জমতে জমতে একসময় সমস্যা হয়। তাই এর সঠিক সময়ে যত্ন নিতে হয় নয়তো পুরনো ক্ষত ভোগায় বড্ড। এক আধটা এরকম দারুন ব্যাথা লাগা আর গেঁজে যাওয়া ছাড়া যেরকম দাম্পত্য আচ্ছে হে। দাঁত অচ্ছে হে।
©----- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
No comments:
Post a Comment