| বহুত্ববাদী জাতীয় খিচুড়ি |
---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
খিচুড়ি’ নামের মধ্যেই আছে এ দেশের বৈশিষ্ট্য। অভিধান বলছে, খিচুড়ি অর্থ ‘বৈসাদৃশ্যময় উপকরণে তৈরি মিশ্র খাদ্য।’ তাই বলে যার সঙ্গে তা মিশিয়ে কিছু একটা করলেই খিচুড়ি হয়ে যাবে, এমন ভাবা ঠিক নয়। যেরকম হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারশিক মুসলমান খ্রিস্টানি পাশাপাশি রাখলেই রাষ্ট্র হয়ে যায় না। যত্ন করতে হয়, একে অপরের চাপে গলে যাচ্ছে কিনা দেখতে হয়, সঠিক আঁচ, সঠিক স্লোগান দিতে শিখতে হয়।
খিচুড়ি করতে হলে চালের সঙ্গে ডাল মেশাতে হবেই। মসুর, মুগ, ছোলা, অড়হর যা ইচ্ছা। এক বা একাধিক। ডাল না মেশালে খিচুড়ি হবে না। এরপর মরশুমি সবজি থেকে ইলিশমাছ, পাঁঠা, শুয়োর বা গরুর মাংস, বাদাম, কিসমিস, তেল, ঘি, নুন, লঙ্কা, হলুদ—যার যেমন রুচি মেশানো সাধ ও সাধ্যমতো।
ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী জাতীয় খাবার নির্বাচন সহজ নয়। ভারত সরকার খিচুড়িকে জাতীয় খাবার হিসেবে তুলে ধরছে তা তো আহ্লাদের খবর। এতেও চক্রান্তকারী গন্ধ কেন? ব্রাহ্মণ, দলিত, কাফের, কবীর, সন্ত, শেখ এক পাতে যে খাবার খায়। সস্তায় পুষ্টিকর, অরাজনৈতিক, চাইলে মাংসাশী না চাইলে শষ্য ও শাকাহারি। খিচুড়ি তো জগাই ভালো। দেশের মত। বিবিধের মাঝে দেখো চালে ডালে মহান।
বিরিয়ানি ভালো, পোলাও পরোটা লববদার কিন্তু খিচুড়ি জনগণতান্ত্রিক। পাত বিছিয়ে বন্যাত্রানে, বাসন্তী পুজো আর বাউলগানে,কাঙালিভোজে, বৃষ্টি হলে, ইলিশ পেলে, বেগুন, নাবড়া, পাঁপড় খেলে। মন ভালো হয়, খিদে জুড়োয়।
ভোগের খিচুড়ি, ইলিশ খিচুড়ি, নবাবি খিচুড়ি, ভুনা খিচুড়ি, শীতের সব্জি দেওয়া খিচুড়ি। খিচুড়ির কোন ইগো নেই, দল নেই, ধর্ম নেই। এক টুকরো পেঁয়াজ পেলেই নিরামিষ খিচুড়ির নিঃসঙ্গতা ঘুচে গিয়ে হয়ে ওঠে উপাদেয়। আবার আদা রসুন পেঁয়াজ বাদে ‘জগন্নাথ দেবের খিচুড়ি’ যা লোকমুখে সংক্ষেপে হয়েছে ‘জগাখিচুড়ি’, তা দৈব গুনে হয়ে ওঠে প্রসাদ যা নাকি শেষ হয় না।
খিচুড়িতে তো বিপ্লবের ও গন্ধ লেগে। তা সে দেশ ভাগের পর শরণার্থী শিবিরে হোক, এদেশের রিফিউজি কলোনি, মুক্তিযুদ্ধকালিন রিলিফ ক্যাম্প - বাস্তুহারা রান্নাচড়ানোর গল্প চাল, ডাল, তেল, লবন, মরিচ হলেই লেখা যায়।
চারিদিকে যুদ্ধ যুদ্ধ গন্ধ। যে যাকে পারছে দেশত্ববোধের পরিক্ষা দিতে বলছে, রাষ্ট্রীয় সংগীত, পতাকা, লৌহ পুরুষ, ইতিহাস হাইজ্যাক করে নেওয়ার অসম লড়াই। খিচুড়ি আমাদের। We The People এর। ক্ষেতে কিষান, কলে মজুর, খেটে খাওয়া নৌজওয়ানের। রিফিউজি পরিবারের, ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানের, বৃষ্টি হলে রসনার, রেড মিটের বাসনার।
বর্গী ও বিজয়বর্গীয়রা রান্নাঘর অবধি চলে এসেছে। হারে রে রে রে অস্ত্র মিছিল। ইমতিয়াজ আর আমি এঁঠো হাতে হাত রেখে বেঁধে বেঁধে আছি। খিচুড়ির হাঁড়ি পরে। কার হাঁড়িতে কি খিচুড়ি, তাতে কি মেশানো হচ্ছে তার জরিপ চলছে। পছন্দ না হলেই পিটিয়ে মারা হবে। সজাগ থাকুন খেতে খেতে। একসাথে। বিসমিল্লা।
©---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
No comments:
Post a Comment