| অয় মারম্ভ শুভায় ভবতু |
এ মায়ার শহরে কোনকিছুর মায়া পুষে রাখা বড় পাপ। বন্ধু বলে মায়া পরতে নেই। সমুদ্র ধারে আরোই না। স্থিতধী স্থবির পাহাড় হয়। এখানে যে সমুদ্র জল।
মুম্বাই বছরখানেক আগে আসার পর থেকেই অনেকগুলো বাসা বদল হয়েছে। শুরু করেছিলাম ওয়রলি সি-ফেস রোড দিয়ে। তারপর পালি হিল, গিরগাও চৌপাটি হয়ে দাদার। প্রত্যেকবার আমার কিছুমাত্র মায়া ফেলে এসেছি আলমারি, শোয়ার খাট, ময়লা বালিশ, নির্দিষ্ট জলের বোতলের গলায়। অনেকাংশ দীর্ঘশ্বাস দেওয়ালে লাগিয়ে এসেছি। খাটের নিচে ধুলো, বোতলের ছিপি, ঝুল, কাগজের টুকরো ছাড়াও কিছু পরে থাকবে বোধহয়।
আমরা সবাই ছেড়ে চলে যাই। কিছু না কিছু। যাওয়ার সময় হুজুক থাকে, তাগিদ থাকে। বেঁচে কুচে যা পরে থাকে, তা থেকেই যায়।
যেরকম চার পেগ খেয়ে বিল মেটানোর পরেও পরে থাকে মাংসের টুকরো, বিটনুন, কয়েকটা কাজু বাদাম। ওগুলো প্রত্যেকটা জরুরি ছিল, ভিষন গুরুত্বের ছিল। কয়েক ঘন্টার ফারাকে ডাস্টবিনে যাওয়ার প্রস্তুতিতে।
ছোটবেলায় দৌড়ে যেতাম।বিকাল সাড়ে তিনটে থেকে গমগম করতো এলাকাটা। আমার কৈশোর। তখন চারধারে প্রচুর কাঁটা ফলের গাছ ছিল। ওগুলো এর ওর চুলে আটকে দিতাম। আর কুলের আচার খেতাম। কুলের বিচি থুঃ করে মুখের জোরে কতদূর যেতে পারে তার কম্পিটিসন হত।
সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব হত। তারপর সব চলে যেত। সব্বাই। পরে থাকতো একটা গোটা মাঠ হাজার খানেক ম্যাচের স্কোর কার্ড, শালপাতা আর ঝগড়ার গল্প আগলে।
স্কুলের শেষ দিন ও তো হুজুগে কেঁদে ফেলা ছিল। একে অপরের স্কুলের জামায় বার্তা ছিল, অনুলিপি ছিল, লিপস্টিক এর স্মৃতি ছিল। কিন্তু সেই জামাও তো এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
আমরা সবাই তো জাহাজের দলে নাম লিখিয়ে ছিলাম, আদার ব্যাপার স্বপ্নে ছিল কই? তাই বোধহয় মায়া রাখতে নেই।
দাদার এলাকাজুড়ে বিছিয়ে দেওয়া স্মৃতি, অনেক রাতে দীপক সিনেমা হল আর স্নেহা ডান্স বার এর পাশ দিয়ে হেঁটে আসা, সকালে মেন্দু বড়া, নির্দিষ্ট দোকানে গাজর, আঁখের রস, ছুটির দিনের গোপাল কৃষ্ণ বার যেখানে ধুপের গন্ধ, জৈনধর্ম, রামের গন্ধ মিলে মিশে মাহল তৈয়ার করে। করতো।
দুটো সুটকেস, খান তিনেক ছোট ব্যাগপত্র, একটা ছাতা আর ব্যাগপ্যাক আমার সংসার। আপাতত। এই নিয়ে এবার চল্লাম নতুন ফ্ল্যাট এ। ভাড়ার ফ্ল্যাট কান্দিভালি। জানালা দিয়ে সবুজ দেখা যায় আর অন্যদিকে হাইওয়ে।
এ শহর দৌড় দিতে শেখায়। যতটা ব্যাগ এ পুরে নেওয়া যায় নস্টালজিয়া ততটা নিয়ে চল্লাম শহরের অন্যপ্রান্তে। এখানে থেকে গেল ভুতুড়ে লিফট, ক্ষ্যাপাটে বুড়ো যে ডাস্টবিন বাইরে থাকলে চ্যাঁচামেচি জুরে দেবে, কম্বল গায়ে মারাঠি উন্মাদ যে গান গেতে গেতে খিস্তি করে, আমার দুই পিজিমেট যারা আমার মধ্যরাতে আগমনে প্রথমে বিস্মিত, তারপর বিরক্ত ও পরে অভ্যস্ত হয়ে যায়। দাদর এলফিন্সটন রোডের ভবানী বিল্ডিং এর দশ তলা থেকে ট্যাক্সি চেপে সোজা হাইওয়ে ধরতে হবে পিছনে না তাকিয়ে। এবার নতুন গল্প শুরু। অয় মারম্ভ শুভায় ভবতু।
---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
No comments:
Post a Comment