| তখন বাজপেয়ী ছিল, বসু ও ছিল : অটল ছিল সৌজন্য |
---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
'পাতালঘর' ছবিতে একটা গান ছিল, "অসতর্ অসতর্ অসতর্ / পৃথিবীটা চালাবার একটাই মনতর্।" আর তা পারমানবিক অস্ত্র হলে তো কথাই নেই। আমেরিকার মতো বিগ ব্রাদার ও তখন সমঝে চলে৷ পাকিস্তান তো মেনি। অটল বিহারী বাজপেয়ী মন্দির বানাক ছাই না বানাক ভারতবর্ষকে পরমাণু শক্তিধর বানিয়ে গেছে। তাকে নিয়ে মাথায় তুলে নাচুন, ঘেন্নায় ছবিতে কালি মাখান কিন্ত তাকে উপেক্ষা করতে পারবেন না।
অটল বিহারী বাজপেয়ী বলতে কী কী মাথায় আসে আপনার?
১৩দিনের প্রধানমন্ত্রী, পোখরানে পারমানবিক অস্ত্র পরিক্ষা, কার্গিলে যুদ্ধ জয়, ভারত-পাকিস্থান বাস পরিসেবা, সোনালী চতুর্ভূজ সড়কপথ, হাঁটুর অস্ত্রোপচার প্রথম পাতার হেডলাইন হওয়া, অনেকটা কথা বলে মাঝে দীর্ঘ বিরতি, শেখর সুমনের হুবহু মিমিক্রি, বাবরি মসজিদ ভাঙার আগের রাতে রক্তগরম বক্তৃতা?
এর একটা শব্দ ও আপনার জুমলা শব্দটার সমার্থক মনে হয়? জুমলা মানে ভাঁওতা। মানে প্রতারণা বা প্রবঞ্চনা। এটি বিশেষ্য পদ। ইদানীং রাজনৈতিক কটাক্ষ করতে ব্যবহার করা হয়।
অটল বিহারী কে নিয়ে পেপারে চ্যানেলে নিত্যদিনের খিল্লি করা, মিমিক্রি করা, কার্টুন, কটাক্ষ লেগেই থাকতো। বাজপেয়ী তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতেন পলিটিকাল স্যাটায়ার। ফোনে সম্পাদককে জানাতেন ও সে কথা। রেগে একটা ও চ্যানেল বন্ধ করার বা সাংবাদিককে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে শোনা যায় নি। উল্টে ডেকে পরের দিনের হেডলাইন দিতেন। সিনেমা নিয়ে আলোচনা করতেন, হিন্দি কবিতার বই উপহার দিতেন। এই ব্র্যান্ড বিল্ডিংয়ের জন্য ৪০০০ কোটি টাকা খরচা করতে হয়নি৷ ওটা সপ্রতিভ ছিল।
অটল বিহারী সেই মানুষ যে তদানিন্তন মুখ্যমন্ত্রীকে পাশে বসিয়ে গুজরাট দাঙ্গার পরে রাজধর্ম পালনের পরামর্শ দেন। রাজার কাছে প্রজায় প্রজায় ভেদাভেদ রাখতে নেই। ধর্ম জাত নির্বিশেষে তারা সমান। গোটা দেশের সাংবাদিক সেদিন অপ্রস্তুত ফ্যাকাশে হাসির ছবি তুলে রেখেছিল৷ মাঝে মাঝেই অভিব্যক্তি বদলে যাওয়া তুলে রেখেছিল তার। দমবন্ধ করা স্তব্ধতা কথার মাঝে।
অটল বিহারী সেই মানুষ যে কট্টর হিন্দুত্বকে স্রেফ নিজের ক্যারিশ্মাতে আম ভারতীয়দের কাছে গ্রহনযোগ্য করে তোলে। মানুষ ভুলে যায় গোডসে কে। তাদের সামনে ধর্ম বলতে তখন রাম আর রাজা বলতে বাজপেয়ী। আমি তখনকার কথা বলছি যখন গান্ধী পরিবারের প্রতি মানুষের সহানুভূতি তুঙ্গে। বিজেপির একটা সাংসদ আর প্রবল জনবিচ্ছিন্ন। এরকম সময় জন্ম নিলো এক হৃদয় সম্রাট যে হিন্দিতে কবিতা লেখে, আবৃত্তি করে, গো বলয়ের প্রান জয় করে আবার চরম দেশভক্ত। অটলবিহারীর হিন্দুত্ব মডেলে ফ্রিজ খুলে গরুর মাংস খোঁজার অজুহাত ছিল না। সংখ্যালঘুকে পিটিয়ে মারার প্রয়োজন ছিল না।
অটল বিহারী সেই মানুষ যে রাজদীপ সারদেসাই এর মতো সাংবাদিককে কোন জায়গায় ভালো স্টেক রাঁধা হয় তার উপদেশ দিতে পারেন। আরএসএস এর থেকে নিজের মন্ত্রীত্ব আলাদা রাখতে পারেন। জর্জ ফার্নান্ডেজ, অরুন শৌরীর মতো মানুষদের সামনের সারিতে আনতে পারেন যাদের আরএসএস যোগ নেই।
আরএসএস এর কট্টর সমর্থক হয়ে ও নেহেরুর মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করতে চলে যেতে পারেন। ইন্দিরার পাশে দাঁড়িয়ে বলতে পারেন, "ভারতমাতা আজ তার সবচেয়ে উজ্জ্বলতম সন্তানটিকে হারালো"৷
আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে বেড়ে উঠেছি, সেই প্রজন্মের অনেকগুলো ঘটনাবহুল জিনিসের সাথে অটল বিহারী বাজপেয়ী জড়িয়ে। এ দেশের আধুনিক ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে। এই ধরুন বাবরি মসজিদ ভাঙা না পরলে ভারতের রাজনৈতিক কম্পাসটাই অন্য দিক নির্দেশ করতো। ভারতের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতার প্রথম বিষবৃক্ষ তো বাজপেয়ীজীর প্রশ্রয়েই। যেমন ২০০২ সালে দাঙ্গার জন্য বকা লাগানোর পরে ও যদি প্রশ্রয় না পেত তদানিন্তন মুখ্যমন্ত্রী, আজ কি সে এই বিরাট শাখা প্রশাখা বিস্তার করতে পারতো দেশের মানচিত্রে? প্রশ্রয় বড় লাগামছাড়া জিনিস। আদবানীজী জানেন।
কিছু বিপ্লবী আজ বাজপেয়ীর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই তেড়ে খিস্তি করছে। লক্ষ্য করে দেখবেন, এরাই জ্যোতি বসুকে বুড়ো ভাম বিদায় নিয়েছে বললে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বুদ্ধবাবুর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীন হয়ে যাওয়াকে পাপের ফল বললে উত্ত্যক্ত হয়। এরা সংসদীয় গণতন্ত্রে আস্থা রেখে ভোট রাজনীতি করবেন কিন্তু বাঁ হাতে ফুলটুকু ও দিতে যাবেন না। পাছে লাইনচ্যূত হয়ে যায় শেষতম দেউলটি। এদিকে ১৯৮৮তে ভিপি সিংকে সামনে রেখে কলকাতার শহিদ মিনারে বাজপেয়ী ও জ্যোতি বসু জনমোর্চার সভা করলে, ভীরেন শাহ এর ঘরে গোপন মিটিং করলে ক্ষতি নেই। ওটা রাজনৈতিক কৌশল।
অটল বিহারী বাজপেয়ী সেই যুগের শেষ কিংবদন্তি যারা বিরুদ্ধমত শুনতে পছন্দ করতেন। যারা কথায় কথায় সেনাবাহিনীর সাথে আম নাগরিকের তুলনা করতেন না, যারা সমালোচনা অপছন্দ হলেই দেশদ্রোহী বলে দেগে দিতেন না।
অটল বিহারী বাজপেয়ী, করুনানীধি, জ্যোতি বসু, সোমনাথ চাটুজ্জে সেই প্রজন্ম যারা সৌজন্য শব্দটার মানে প্রজাতন্ত্রে বুঝতেন। যারা রাজনীতির উপরে স্টেটসম্যানশিপকে রাখতেন৷
এখন শেক্সপিয়র থাকলে বলতেন, Something is wrong in the state of India। আমরা বোধহয় ক্রমশ পিছোনের দিকে হাঁটা লাগিয়েছি।
জ্যোতি বসু তাঁর ভাষণে খোলাখুলিই বিজেপি দলকে ‘অসভ্য ও বর্বর’ বলে গালমন্দ করতেন। একবার বাজপেয়ী অনুযোগের সুরে জ্যোতি বসুকে বলেছিলেন, আপনি আমাকে কেন ‘অসভ্য বর্বর’ বলে জনসমক্ষে গালমন্দ করেন বলুন তো? বসু তাঁকে উত্তর দিয়েছিলেন, আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ওই কথা বলি, তা তো নয়। আমি আপনাদের দলকে এই কথা বলি। বাজপেয়ী বলেছিলেন, কেন ? উত্তরে বসু বলেছিলেন, বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে আপনাদের দল যে অন্যায় করেছে, তারপর ‘অসভ্য ও বর্বর’ ছাড়া আর কোন কথা আপনাদের দল সম্পর্কে খাটে বলুন তো? যদি অন্য কোনো শব্দ আমাকে জানাতে পারেন, জানাবেন।
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত জ্যোতি বসু সভা-সমাবেশে এই ঘটনাটি পুরোটা বলতেন, ঘটনাটি বলে শেষে বলতেন, ‘আজ পর্যন্ত বাজপেয়ী কিন্তু আমাকে জানাননি যে ‘অসভ্য ও বর্বর’ ছাড়া আর কোন শব্দ তাদের দলের জন্য ব্যবহার করা যায়’! বাজপেয়ী চুপ করেই থেকেছেন।
হয়তো তখন sensibility বলে কোন শব্দ ছিল। রাজনৈতিক সৌজন্য, যুক্তিবাদ বেঁচে ছিল। ব্যক্তি ও দলের ফারাক বোঝার মস্তিষ্ক ছিল। আধা বিপ্লবী আর পুরো অর্ধশিক্ষিতের সংখ্যা দু দলেই কম ছিল। তখন বাজপেয়ী ছিল৷ বসু ও ছিল। আর অটল ছিল সৌজন্য।
©---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
No comments:
Post a Comment