কবির কদর নেই জীবদ্দশায়, কবির কবর দেয়া হয় না।
থাকলে,এপিটাফ কদর দিত/কোন নিষিদ্ধ প্রেমিকার মতো।

mayukh speaks

My photo
kolkata, west bengal, India
A media professional and a wanderer by passion. Blogger and social observer. loves to watch world films and hear different music genre.

Monday, August 20, 2018

জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল

| জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল |

---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

সাংবাদিকদের অনেক সময়ই মন্থরা দাসী বা নারদের ভূমিকা পালন করতে হয়৷ পৃথিবীতে সব ঠিক থাকলে খবরের কারবার থাকে না। সুতরাং দ্বন্দ্ব বজায় থাকতে হয়।

২০১৭তে জিএসটি বিল যে দিন সংসদে পাশ হবে, সেদিন বামেরা হাউস বয়কট করবে বলে ঠিক করে৷ কিছুটা অস্বস্তি তৈরি করেই সেদিন খবর করেছিলাম, এই বামেদেরই বর্ষীয়ান নেতা অসীম দাশগুপ্তের মোদী সরকারের আমন্ত্রণে উপস্থিতি নিয়ে। উনি জিএসটির প্রথম ড্রাফট লিখেছিলেন। ওদিনই মুম্বাই থেকে ওনার একটা ফোনে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। বড় করে চলেওছিল।বিস্ফোরক মন্তব্য করেছিলেন দিল্লি বসে। তিনি নাকি পলিটব্যুরোকে বুঝিয়েছিলেন জিএসটির সুফল। তিনি এও বলেছিলেন, জিএসটি সমর্থন করছেন।

খবরটা আরো পোক্ত করতে বদবুদ্ধি মাথায় আসে এক। ফোন ঘুরিয়ে দিই বিরাট মাপের সেই মানুষকে।সোমনাথ বাবু। কলকাতার বাড়িতে থাকলে উনি কাজের মাঝে সন্ধেবেলাটা টিভি দেখেই কাটাতেন। পাশে থাকতো ফোন।নিজেই ধরতেন। পেছনে টিভির আওয়াজ আসতো। সেদিন ও যেমন। কয়েকবার বাজার পরে ওঠান৷ অনুমতি চাই ফোন রেকর্ড করার৷

সেদিন একথা সেকথায় প্রায় ১৫মিনিট কেটে গেছিল৷ প্রশ্ন করেছিলাম জিএসটি নিয়ে বামেদের এই অবস্থান দ্বিচারিতা মনে হচ্ছে না? অনেকগুলো কথা বলে ফেলেছিলেন। তারপর কি মনে হওয়ায় বললেন, "এগুলো তোমায় বললাম, ব্যবহার করো না। এসব তোমরা করবে কিন্তু বিব্রত হবে ওরা। এই সময় ওদের দুর্বল করে দেওয়া কোন কাজের কথা না"৷

খুব রাগ হয়েছিল। মনে মনে হেডলাইন,সুপার, টিকার লাইন ভেবে রেখেছিলাম, ফোন রেকর্ড ও ছিল কিন্তু একটাও ব্যবহার করতে পারবো না বলে হতাশ হয়েছিলাম। তার থেকে ও বেশি বোধহয় এজন্য কারণ যুক্তি খুঁজে পাইনি এই আনুগত্যের। অনুজ নেতাদের প্রতি স্নেহের। পাহাড় প্রমান অভিমানের পরে ও মানুষ পার্টিজান থাকতে পারে?

সোমনাথ বাবুকে দল বহিস্কার করেছিল যে ধারায় সেটা দলবিরোধী কাজের জন্য শুধু নয়, শত্রুপক্ষকে সুবিধা করে দেওয়ার মতো গর্হিত অপরাধ। যোগাযোগ রাখা ও পাপ ছিল। তাই দেখাতে হতো। কিন্তু আদপে আমরা যারা সংবাদমাধ্যমে আছি, তারা জানি কারা কারা কতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলতো৷ প্রশ্ন করলেই বলা হতো, দলের সিদ্ধান্ত জানোই তো কিন্তু ব্যক্তিগত স্থরে সোমনাথদা কে কি করে ভুলে যাবো? অবাক হতাম, সব্বার যখন ব্যক্তিগত সম্পর্ক এতো ঘন, বহিষ্কার কি করেছিল একজনই কেবল?

মৃত্যুর সকাল থেকেই হাঁটি হাঁটি পায়ে চেষ্টা চলছিল হাইজ্যাক করার। প্রথমে সাধারণ সম্পাদক বলে বসলেন, দেহ আলিমুদ্দিন যাবে। রাজ্য সম্পাদক বললেন, রোজ যোগাযোগ রেখে চলতাম। 'অমর রহে' আর 'লাল সেলামের' বন্যা বইলো।

যারা সামন্তদের বিরুদ্ধে লড়বে, তারাই কেমন যেন সামন্ততান্ত্রিক হতে শুরু করলো। তোমাকে যতই লাথি ঝাঁটা মারি বাপু, শেষমেশ তুমি দলের দোরগোড়াতেই মাথা ঠেকবে। না ঠেকলে তোমায় সামাজিক বয়কট করা হবে। লোকাল কমিটিকে দিয়ে হেনস্থা করার দশটি উপায় বাতলে দেওয়া হবে।

যারা একসময় সরকারে থাকবে বলে ভোট লুঠকে এক শৈল্পিক ছোয়া দিয়েছিল রিগিং করে, যারা ২৩৫ আসনে জেতার অহং পুষেছিল, যারা ৬২জন সাংসদকে নিয়ে উঠতে বসতে সোনিয়া গান্ধীকে সরকার ফেলে দেওয়ার থ্রেট দিতো, তারাই দশবারের জেতা সাংসদ, লোকসভার দেওয়ালে কটা ইট আছে গুনে দিতে পারে এমন সদস্যকে বহিষ্কারের মূর্খামি করতে পারে। তখন সংসদীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা ছেড়ে দম্ভ সবার ওপর। আদর্শ আর লাইনের এলিবাই রেডি। এমন ভাব যেন কালই জলপাই পোষাক পড়ে সব্বাই বন্দুক কাঁধে বিপ্লব করতে বেরোবে দান্তেওয়াড়াকে বসত করে। বাকি সব ঝুটা হে৷

সোমনাথ বাবু মরিয়া প্রমাণ করিলেন কিছু কিছু জিনিস পার্টির ঊর্ধ্বে থাকে৷ কেউ কেউ গোঁয়ার গোবিন্দ, কাগুজে বাঘ, পিবি, সিসি, পিসির ঊর্ধ্বে হয়৷ মানুষ বানিয়ে তোলে৷ আর কে যেন বলেছিল, মানুষই শেষ কথা বলে?

এটাকেই বামপন্থা কয় কত্তা। ঘুপচি এসি ঘরে, নিকারাগুয়ার জিডিপি নিয়ে মিটিং করতে করতে রিড করতে পারোনা। তাই তালিবানি ফতোয়া জারি করো৷ তালিবানি গোঁয়ার্তুমি আর দলীয় সংকীর্ণতাকে শৃঙ্খলার নাম দাও। কমিউনিস্ট তো হবে সিংহ হৃদয়। মানুষের জন্য, মানুষের দ্বারা চালিত এক মুক্তমনা। যুক্তিবাদী তুখোড় মাথার মানুষ। কয়েকটা গাম্বাটকে যদি এ দায়িত্ব দেওয়া হয় তবে তো মুশকিল। তাদের একমাত্র কাজ মরা ছোঁয়ার মতো লেনিন স্ট্যালিনের কিছু কীর্তির উদাহরণ দেওয়া আর তার মতো এক সমাজ গড়ে তোলা। এতে কোন নিজস্বতা নেই। কোন নতুনত্ব নেই। রাজ চক্কোতির মতো টুকে দাওয়া। লাগলে মার্কসবাদী তুক নয়তো হিস্টোরিকাল তাক।

আজ অনেকে হেব্বি খুশি সোমনাথ বাবুর ছেলে বিমান বসুকে খেদিয়ে দেওয়ায়। আলিমুদ্দিনে দেহ না নিয়ে যাওয়ায়। বিমান বাবুর বাবা যেদিন মারা গেছিল, সেদিন কয়েক ঘন্টার জন্য বাড়ি গিয়ে সৎকার করে ফের দলের কাজে লেগে পরেছিলেন মানুষটা। আদপে বয়স্ক শিশু। সুভাষ জ্যোতি বসুর মৃত্যুতে যে ফুঁপিয়ে কাঁদেন। ওনাকে এই অপমানটা না করলে ও হতো। দীর্ঘ পথ এরা রাগে ঝগড়ায় বিপ্লবে বিদ্রোহে একসাথে হেঁটেছে। বিমানে বাবুর ও অনেকটা বয়স হলো।

শেষে প্রতাপ চট্টোপাধ্যায় মানে সোমনাথ বাবুর ছেলেকে একটাই কথা বলবো। সিপিএম এর উপর রাগ থেকে না হয় বিমান সূর্য কে দূর করে দিলেন কিন্তু সোমনাথ বাবু আমৃত্যু নিজেকে বামপন্থী ভেবে গেছিলেন। মৃত্যুর পরে দেহ লাল পতাকায় মোড়ানো থাকবে, উদাত্ত কন্ঠে ইন্টারন্যাশনাল গাওয়া হবে, রাস্তার দুধারে মিছিল করে চলবে মানুষ,  অর্ধনমিত লাল পতাকা হাতে। সোমনাথ বাবু দেহদানের মতো ওটাও চাইতেন।

খুব কি কিছু এসে যেত যদি একটা লাল পতাকা শেষ যাত্রায় ওনার গায়ে মুড়িয়ে দেওয়া হতো? লাল পতাকা তো কারোর বাপের নয়। যে যেখানে আমাদের লড়াইটা লড়ে যাচ্ছে তাদের প্রত্যেকের লাল পতাকা প্রাপ্য৷ একটা ইন্টারন্যাশনাল প্রাপ্য। দলের ঊর্ধ্বে।

আজ ফুল হাতে না এসে বোধহয় একটা লাল পতাকা হাতে এলে পারতো বিমান বাবুরা। কিংবা একটা সাধারণ সদস্যপদের রসিদ নিয়ে বা নিদেনপক্ষে একটা গনশক্তির ডায়রি থেকে ছেড়া চিরকুট দেহের বুকপকেটে রেখে দেওয়ার জন্য। লাল কালিতে লেখা থাকতেই পারতো :

" ক্ষমা করো সোমনাথ দা।"

©----- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

No comments:

Post a Comment