| উবুন্টু |
----- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
#কলকাতা #মেডিকেলকলেজ #অনশনশেষ ✌
পশ্চিমদেশের সাহেবদের আফ্রিকা নিয়ে বরাবরের একটা এক্সপেরিমেন্ট করার প্রবনতা কাজ করে।
আফ্রিকার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এক নৃতত্ত্ববিদ কিছু বাচ্চাকে নিয়ে একটা খেলার আয়োজন করে একদিন। খালি গা, অনাহারের ছাপ স্পষ্ট, অপুষ্টিতে ভোগা কিছু পাঁচ সাত বছর বয়সী বাচ্চাকে খেলতে ডাকে সাহেব। ওই এক্সপেরিমেন্টর অংশ হিসেবেই।
এক ঝুড়ি সুস্বাদু ফল, মিষ্টি, চকোলেট রাখা হয় সবার মাঝে। উজ্জ্বল হতে থাকে প্রতিটা চোখ। সব্বাই ওই লোভনীয় ঝুড়ি পেতে চায়।
কিন্তু সাহেবের শর্ত, ওই ঝুড়ি রাখা থাকবে দূরের এক গাছে৷ যে ওই ঝুড়ি পেতে চায়, তাকে সব্বার আগে দৌড়ে গিয়ে ওই ঝুড়ি মাথায় নিতে হবে। তবেই ফল, মিষ্টি, চকোলেট সব পাবে বিজেতা। বাকি যারা হেরে যাবে, তারা এর একভাগ ও পাবে না। এটাকেই নাকি প্রতিযোগিতা বলে।
সাহেব এক টান টান দৌড় প্রতিযোগিতা দেখবে ভেবেছিল। কিন্তু অবাক করে দিয়ে, সব কটা বাচ্চা রেস শুরু হতেই হাতে হাত ধরে একসাথে, এক গতিতে দৌড়তে শুরু করলো। গাছের কাছে এসে একসাথে সব্বাই ঝুড়িটা ধরে নামিয়ে আনলো, তারপর সব্বাই মিলে খেতে লাগলো সুস্বাদু চকোলেট, মিষ্টি, ফল।
সাহেব জিজ্ঞেস করেছিল ওদেরকে, তোমরা একসাথে দৌড়ে ঝুড়ি টা নামিয়ে আনলে কেনো? যখন তোমাদের সুযোগ ছিল বাকিদের হারিয়ে দিয়ে পুরোটা জেতার।
চকোলেট মুখে পুরে, ফোকলা দাঁতের এক বাচ্চা বলেছিল, উবুন্টু! মানে ওদের ভাষায় যদি অন্য সবাই দুঃখে থাকে তবে আমাদের মধ্যে কেউ একজন সুখী হবে কি করে?
ওই যে মেডিকেল কলেজে আজ আবীর মাখা গালগুলো দেখলেন, মুষ্টিবদ্ধ হাতগুলো দেখলেন, অনেক খেটেখুটে জয়েন্টে চান্স পেয়ে ও সারাদিন বইতে মুখ না গুঁজে ভুখ হরতাল করতে দেখলেন কিছু দামাল ছেলেমেয়েকে সব্বার প্রাপ্য হোস্টেলের দাবীতে, ওটাই উবুন্টু। কি আশ্চর্য হোস্টেল মানে ও তো ওই পাশাপাশি একে অপরকে সাহায্য করে এক ছাদের তলায় থাকা। অনেকগুলো গল্প তৈরি করে যাওয়া।
উবুন্টু মানে ওই যে মাঝরাতে ফোন পেয়ে বন্ধুর বাবার জন্য হাসপাতালে জাগা। পরীক্ষার আগের দিন দারুন বৃষ্টিতে পাশের বাড়ির কারো মৃত্যুতে শ্মশানযাত্রী হওয়া। প্রানের বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত কেউ বা কারা আসছে শুনে যে যেখান আছে সেখান থেকে মেন গেটে মানববন্ধন করে নেওয়া৷
উবুন্টু মানে এই কলকাতা শহরের বুকে ৮৪' সালে একজন ও শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষের গায়ে আঘাত হানতে না দেওয়া৷ উবুন্টু মানে ৯২' সালে বাবরি মসজিদ ভেঙে যাওয়ার পরে পাড়ার হিন্দু ছেলেদের পালা করে রাতজাগা মুসলমানী ঘরের সামনে৷ উবুন্টু মানে তো রামনবমীর মিছিলে হাঁটতে গিয়ে ক্লান্ত হলে ফেজটুপির সরবত এগিয়ে দেওয়া।
ডেসমন্ড টুডু আর নেলসন ম্যান্ডেলা বহু আগে উবুন্টুর মানে বুঝে ওদের আন্দোলনের নাম রেখেছিলো। ৩০০ বছরের ঝড় ঝাপ্টা সামলে এগিয়ে চলা আমার মহানগর ও আবার প্রমাণ করলো যদি এ শহরের কিছু ছেলে দু হপ্তা না খেয়ে দুঃখে থাকে তবে সহনাগরিকদের একজন ও সুখী হবে কি করে?
নবদুর্বাদল দেশে অনেক উঁচু ফ্ল্যাট বাড়ির আইসোলেটেড সৌখিনতা, নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির প্রাইভেসি, ক্যারিয়ার সর্বস্ব ইঁদুর দৌড় আর মিটিং-মিছিল-ঘামের গন্ধ থেকে দূরে থাকার প্রতিযোগিতা শেষ হলে ওই উবুন্টুই বেঁচে থাকে মিলনদার চায়ের ঠেকে, পাড়ার রকে, ইউনিয়ান রুম, ক্যান্টিন, লিটল ম্যাগাজিন স্টলে৷ অনিকেতরা সবটা বোধহয় অন্ধকার হতে দেয়নি। তাই হয়তো আজ ও পাথরপ্রতিমায় স্বাস্থ্য শিবির হয়, তাই হয়তো বিনায়ক সেনদের জেলে যেতে হয়, তাই হয়তো বান্দোয়ানে কোন ডাক্তার সাইকেল চেপে মাঝরাতে পাড়ি দেয় হিপোক্রেটিসের শপথ রক্ষার্থে।
কবি তো কবেই লিখে গেছিলো নাগেরবাজারে বসে। আমরা অন্ধকার সময়ে হাতড়ে গেছি স্রেফ আলো।
"কিছুই কোথাও যদি নেই/ তবু তো কজন আছি বাকি। আয় আরো হাতে হাত রেখে/ আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।"
©----- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
No comments:
Post a Comment