| গুজব |
---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
গুজব বলতে ছোটবেলায় ভাবতাম আনন্দলোক আর নবকল্লোল এর প্রচ্ছদ কাহিনী। রসালো, ধারনানির্ভর, দুপুরবেলা বালিশ চেপে বা সন্ধের ক্যারাম ঠেকের মাখোমাখো খোরাক। গ্লসি ছাপার অক্ষরগুলো কখন যেন আমার বাড়ি, মায়ের শাড়ী, ভাতের থালা, বাবার পিটিয়ে মারা লাশের সাথে জ্বলতে থাকলো। গুজবে।
গুজবেই তো যুদ্ধ লাগে। গোল্লাছুটের মাঠ, প্রিয় শহর, পোষা বেড়ালছাড়া হতে হয় লেখককে। পরে থাকে না পাওয়া স্বীকৃতি, অপমান, এক ডক্টর কি মউত!
গুজবকে ইদানীং আঙুলে ছোঁয়া যায়, মোবাইল থেকে মোবাইল ছিটিয়ে দেওয়া যায়। সরকার নাকি এবার ৫০টাকার নোট বাতিল করবে, গণেশ ফের দুধ খাবে, ফেসবুক দাম দিয়ে ব্যাবহার করতে হবে, জিএসটির জন্য পোস্ট আপিসে সুদের হার ৪% হবে ইত্যাদি।
গুজবের গরু তুলসী গাছে ওঠে, মুসলিম ছেলের পাশে বসে করুণভাবে, মায়ের রুপ নেওয়া মাত্র তাকে নিধন করা হয় চাপাতি দিয়ে, তারপর ট্রেনে ধরা পরে নির্ঘাত কোন বীর হিন্দু পরিত্রাতার হাতে।
গুজবেই তো রক্ত গরম হয়। ভোজপুরি ছবির বলাতকার দৃশ্য বেমালুম চালিয়ে দেওয়া হয় হিন্দু নারীকে প্রকাশ্য রাস্তায় নগ্ন করা হয়েছে বলে। পাল্টা লোক জড়ো হয়, নবীর ছবিতে বিকৃতি করা হয়েছে মাইকে প্রচার করে। মন্দিরে গরু ছোঁড়া হয়েছিল, পবিত্র গ্রন্থকে কি সাংঘাতিক সব....
গুজবেই তো ১৮৫৭ এর সেপাই বিদ্রোহ। দাঁতে কাঁটতে হবে গরু ও শুয়োর। গুজবেই তো সংবাদ শিরোনাম দাদরি। মুর্শিদাবাদ এ শিশুচোর সন্দেহে মহিলাকে পিটিয়ে মারা। বাদুরিয়ায় ঘৃণায় ঘৃতাহুতি।
গুজবের মিউজিয়াম হয়? সাজিয়ে রাখা যায় রাজ্যের যত গুজব দেওয়াল এ দেওয়ালে? নন্দীগ্রামে সরকার সব জমি কেঁড়ে নেবে জোর করে, সোনারপুরে বিদ্যুৎ প্রকল্প হলে ভেরীর মাছ মরে যাবে, পোলিওর টিকা নিলে শিশু বিকলাঙ্গ হবে, বহুজাতিক শিল্প এলেই পুঁজিবাদী কালো হাত পিছু পিছু আসবে আর আমরা সংশোধনবাদী হয়ে যাবো।
গুজবে আমার শাঁখ আর আজানের সন্ধেবেলা, কাওয়ালির তালি শেষে কীর্তনের খোল, মেহতাব আর দীপেন্দুর ফুটবলমাঠ, বিসমিল্লার সানাই, ড্রাইভার চাচার পুজোর ভোগ চেটেপুটে খাওয়া, আয়াত আর লালন সাঁই এর শপথ চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমার সামনে। আমি তখন পৈতে কানে প্যাঁচাচ্ছি, আমি তখন ফেজ টুপি মাথায় পড়ে তৈরি। ঘর ভাঙবো।
গুজব নিয়ে অনেকদিন আগে একটা ছোট ছবি দেখেছিলাম। এক হিন্দু নাপিতের দোকানে এক মুসলিম খদ্দের, বন্ধু ও বটে সে, দাড়ি কাটতে এসেছে। টিভিতে খবরের চ্যানেল চলছে, সিয়াচেন মে জওয়ান মরছে, কেউ কেউ পাক পতাকা ওড়াচ্ছে, বাকি জায়গায় না কামানো দীর্ঘ দাড়িতে সন্দেহ।
নাপিত তার খদ্দের বন্ধুর সাথে হাজার গল্পে মশগুল ক্ষুর চালানোর আগে। চুটিয়ে আড্ডা ক্রীম মাখাতে মাখাতে, তোয়ালে চাপিয়ে, চেয়ারে হেলান দিয়ে।
আচমকা সামনের রাস্তায় কয়েকজন ফেজ টুপি পড়া ছেলে তলোয়ার হাতে এক গেরুয়া ধুতি পড়া লোককে মারতে শুরু করলো। এক সময় তরোয়াল ও ঢুকিয়ে দেওয়া হল।
সেলুনে নাপিত ক্ষুর হাতে, বন্ধু খদ্দের চোখ বন্ধ করে। নিশ্চিন্ত ক্রীম মাখানো গাল। গলার কাছ থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পরছে। টিভিতে তখনো খবরের চ্যানেল চলছে, সিয়াচেন মে জওয়ান মরছে, কেউ কেউ পাক পতাকা ওড়াচ্ছে, বাকি জায়গায় না কামানো দীর্ঘ দাড়িতে সন্দেহ।
সবাইকে চমকে দিয়ে এক বাজখাঁই চিৎকার- কাটটটট, যে গেরুয়া ধুতির লোকটাকে ফেজ টুপির ছেলেগুলো কোপাচ্ছিল, সে উঠে বসলো। বুকে টমেটো সস লাগা। ছবির শুটিং ছিল।গুজব।
সব ঘটনা শুটিং হয়না। আসুন সময় থাকতে শুধরে নিই নিজেদের। গুজবে কান না দিয়ে হাতে হাত ধরে রুখে দিই দাঙ্গাবাজদের। আয়াত বা মন্ত্রোচ্চারণ হোক মানবতার। খেটে খাওয়ার। গুজবের না।
---© ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
No comments:
Post a Comment