| সিনেমা হলে সিরিয়াল ব্লাস্ট, সিটের নিচে ধুলাগড় |
বম্বে একটা অদ্ভুত মায়াবী শহর। এর শরীর জুরে একরাশ গল্প ছাপা। এ শহরের সমস্ত কিছুতেই গল্প বুঁনে রাখা। সমস্ত দালান কোন ইতিহাস বহন করে চলেছে। সমস্ত রাস্তার নাম কোন উত্তরাধিকার সযত্নে বহন করে চলেছে। বা কোন গভীর ক্ষত। এ শহর সমস্ত টা দিব্বি নিজের মতো গল্পে বাঁচিয়ে রেখেছে।
আমি একা সিনেমা দেখতে দীর্ঘদিন ধরে অভ্যস্ত। ভারি গায়ে লাগে মাল্টিপ্লেক্স এ ৫০০টাকা খরচ করতে একার জন্য। তাছাড়া ছোটবেলা থেকে সিঙ্গিল স্ক্রিন যে আমায় দারুন হাতছানি দেয়।
সিঙ্গিল স্ক্রিনে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার থাকে।সেখানে যে ফিল্ম দেখে স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে আসে ও ফুঁপিয়ে কান্না ঝরে, সেই ছবি অসাধারণ।
অন্ধকার হলে, প্রজেক্টার এর দিকে একটানা তাকিয়ে থাকলে নাকি ম্যাজিক এর মতো টাইম মেশিনে চড়ে বসে যে কোন সময় নিয়ে আসা যায় সেলুলয়েডে।
আমার বাবা আমাকে প্রথম সিনেমা হলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় বান্টিতে। বান্টি একটি হলের নাম ছিল। ক্রমে গোটা এলাকার নাম হয়ে যায় বান্টি। নাকতলার পরের স্টপ। যেখানে হালে মেট্রো স্টেশন হয়েছে।
বান্টি তে জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র দেখি খুদা গাওয়া! তিন ঘন্টা অপলক দৃষ্টিতে মানুষগুলো তাকিয়ে থাকতো স্ক্রিনের দিকে।নেশা ওখানেই শুরু।
তখন আইনক্স ছিল না। থাকার মধ্যে আমার দুনিয়া জুড়ে ছিল বান্টি, মহুয়া, পদ্মশ্রী,মধুবন, মালঞ্চ। দক্ষিণ কলকাতার ছেলে আমি। আগাগোড়া গড়িয়া।
কাঠের চেয়ার, ঘুটঘুটে অন্ধকার হল, টর্চ লাইট জ্বালিয়ে সিট দেখিয়ে দেওয়া, সস্তার টিকিট এ মার্কার দিয়ে লেখা সিট নম্বর, ইন্টারভ্যালে প্যাটিস। আমার এক নিমেষে হিপনোটাইস এর যন্ত্র ছিল সেলুলয়েড।
আমার দারুণ লাগে সিনেমা হলের ওই ভোঁটকা গন্ধ। হলে ওই EXIT লেখা আর চারপাশের অন্ধকার। ওখানে নাকি সপ্তাহে সপ্তাহে স্বপ্ন দেখা যায়। স্বপ্নে নায়ক অমর হয়ে যায় আর হল মালিক নিঃস্ব।
বম্বে শহর এ আমার ভাড়াবাড়ির ঠিক পাশেই একটা দারুণ সিনেমা হল আবিষ্কার করেছি। দাদুলদা দের প্রিয়ার মতো ঝকঝকে তকতকে। দোতলার সিট ১৫০ টাকা। বম্বের তুলনায় সস্তায় পুষ্টিকর।
প্রতি সপ্তাহে একটা ছবি বাঁধা। সাথে টুকটাক। আর বাকিটা ওই অন্ধকার ঘরটা। নেশার মতো। অফিসে আমার এই আবিষ্কার নিয়ে আজ কথা হচ্ছিল। আমাদের অফিসেই এক প্রবীণ মারাঠি সাংবাদিক আমায় খুব স্নেহ করেন। শুনে টুনে বললেন, প্লাজা তে আমরা ও বহু ছবি দেখেছি। বাড়ি থেকে মারাঠি ছবি দেখতে যেতাম। তারপর আর যেতে পারিনা। পুরনো কথা মনে পরে, অর্ধেক শরীর উড়ে যাওয়া বন্ধুর কথা।
আমি মাঝপথে থামিয়ে দিই। মানে?
প্রবীণ মারাঠি ভদ্রলোক বলেন, বাবু, প্লাজা সিনেমা ৯৩' সিরিয়াল বম্ব ব্লাস্ট এর একটা টার্গেট ছিল। সিটের নিচে আরডিএক্স রেখে দেওয়া হুয়েছিল ওই অন্ধকার ঘরটায়। অন্ধকার হলে, প্রজেক্টার এর দিকে একটানা তাকিয়ে থাকা লোক গুলো টের ও পায়নি। ম্যাজিক এর মতো সেলুলয়েডে বুঁদ হয়েছিল। ৫৩ জন মানুষ মারা যায় ওই বিস্ফারণ এ। প্লাজা সিনেমা তে।
প্লাজা তে লিওপল্টের মতো বন্দুক এর চিহ্ন স্বযত্ন রাখা নেই। রাখার মধ্যে প্রচুর পুরনো ছবির সিলভার জুবিলি, গোল্ডেন জুবিলি স্মারক। আর ভারি অদ্ভুত নেশাতুর চারপাশ।
অন্ধকার ওই ঘর স্বপ্ন দেখায়। যারা ওই স্বপ্ন কে খুন করে, তারা কাপুরুষই। তাদের কোন মতবাদের দোহাই দিয়েই বিপ্লবী বা স্বাধীনতা সংগ্রামী বলতে পারবো না।
আমার রাজ্যেও এই ধরনের কিছু মানুষ ঢুকে পরেছে। যারা কিছু টাকার বিনিময় সিটের তলায় বোম বা নিচের পেটে বেল্ট বেঁধে উড়িয়ে দিতে পারে আমার সমস্ত স্বপ্ন। তারা আমার বন্ধু নয়, তারা গান ভালোবাসে না, ভালো গরুর মাংস কষা রান্না করতে জানে না। এরা ঘটনা চক্রে কোন নির্দিষ্ট ধর্ম মেনে চলে। বাকিটা খুব খারাপ কিছু গুরুর আয়াত। মানুষ এ মানুষ এ লড়াই করার ফতোয়া।
আমার দেশের চূড়ামণি ও অনেকটা এরকম। ত্রিশূল শান নিচ্ছে প্রতিদিন। কি জানি এর মাঝে আমাদের ছবি দেখা গুলো কবে প্রচন্ড বিস্ফারণ এর শব্দে লাশ এ বদলে যাবে। মুম্বাই এর প্লাজা তে বিস্ফারণ নাকি কোন মসজিদ গুড়িয়ে দেওয়ার বদলা ছিল। কিন্তু হাওড়া?
সিটের নিচে বোমা রাখা। টিক টিক টিক টিক হয়েই চলেছে। দিদি শুনতে পাচ্ছো?
----ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ