কবির কদর নেই জীবদ্দশায়, কবির কবর দেয়া হয় না।
থাকলে,এপিটাফ কদর দিত/কোন নিষিদ্ধ প্রেমিকার মতো।

mayukh speaks

My photo
kolkata, west bengal, India
A media professional and a wanderer by passion. Blogger and social observer. loves to watch world films and hear different music genre.

Saturday, February 25, 2017

| ওহ! ডাক্তার |

আমার মা বাবা দুজনেই পেশায় চিকিৎসক। সরকারি হাসপাতালের জিপি। রোজ ৬০০ রোগী আসে, টিকিট কেটে ওপিডি-তে রোগ নিয়ে লাইনে দাঁড়ায়। কখনো রাগে ফেটে পরে। কখনো বাড়ির সব্জি নিয়ে আসে ভালোবেসে। ভগবান তবে মাটির কাছাকাছি।

আমি ছোটবেলায় এসব দেখেছি। ছোটবেলার অনেকটা সময় আমি সোনারপুর হাসপাতাল কোয়ার্টার এ কাটিয়েছি। নার্স, আয়া মাসিমাদের মাঝে।

মা বাবা ছাড়া আমার বোন ও ডাক্তার হব হব করছে। আমি বাদে এরা সবাই ডাক্তার। আমি জয়েন্ট এ এমবিবিএস এ পাইনি। ডেন্টাল এ পেয়েছিলাম। একটি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ এ নাম ও লেখানো হয়েছিল। কিন্তু প্রথম সপ্তাহে যা বুঝলাম তা হল আজীবন আমায় পুরুষ ও মহিলার ঠোঁটের খুব কাছে থেকেও কেবল দাঁতের গন্ধ শুঁকে অর্থ উপার্জন করতে হবে। কারন আর যাই হোক আমি ভালো ডাক্তার হতে পারতাম না।

সেলসম্যান হয়ে রোগী আনতাম বটে। কায়দা, ঠাঁট ও শিখে নিতাম কিন্তু মন শায় দেয়নি। অভিনয় ও শোম্যানশিপ করতে হলে ডাক্তার সেজে কেন, অভিনেতা, নেতা বা নিদেনপক্ষে সাংবাদিক সেজে করবো। ডাক্তার তো রুগী দেখবে। পাশে থাকবে, বকা দেবে অশিক্ষা দেখলে, কাঁধে হাত রেখে হনহন করে হেঁটে চলে যাবে।

ছোটবেলায় স্কুলের বন্ধুরা ভাবতো ও বলাবলি করতো যে আমাদের নাকি বহু গাড়ি, সাত মহলা বাংলো বাড়ি, ৭৭ ডজন মায়ের শাড়ি ও আমার এক আলমারি খেলনা আছে। কারন আমার মা বাবা দুজন ডাক্তার। ডাক্তার দের এসব থাকে। তারা ওষুধ এর কাটমানি নেয়, অপারেশন করে কিডনি বের করে নেয় তবে তারা ভগবান। আমার লজ্জা লাগতো আর রাগ ও। বাস্তব এ এর একটা ও দেখিনি। থাকার মধ্যে সাকুল্যে একটা অল্টো গাড়ি, ভালো ভাবে থাকার জন্য জরুরি মধ্যবিত্ত যা কিছু। উচ্চাশা ছিল।

উচ্চাশা থাকা কি অপরাধযোগ্য? একজন ডাক্তার যে ১০ বছরভর মাথা গুজে শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, তার উপর আরো দক্ষ হওয়ার শিক্ষা, ক্লিনিক এ রোগী দেখা শেখে, তার কি শখ থাকতে পারেনা রোগী দেখে একটি টয়োটা কেনার?

একটি ফটকায় ব্যাবসা করা দালাল, ড্রেন তৈরির টাকা থেকে কাটমানি খাওয়া কাউন্সিলর ও স্কোরপিও চড়ে। আর ডাক্তার জ্যান্ত লোকের কল কব্জার ভার নিয়েছে।

এরপর এক দক্ষ এমবিএ পাশ কিছু ওষুধ কোম্পানি তাকে মার্সিডিজ এর স্বপ্ন দেখায়। কিচ্ছুটি করতে হবেনা। স্রেফ বিশেষ ট্যাবলেটটা লিখে যেতে হবে বা রোগীকে ভয় পাইয়ে টেস্ট করতে পাঠাতে হবে। নিদেনপক্ষে একটা আইসিইউ বেড এ পাঠানো। ডাক্তার এর কথায় সব হয়। ডাক্তার ভগবান।

কিন্তু ভগবানকে যেরকম মানুষ এর মত হাগু করতে দেখলে, চুমু খেতে দেখলে প্রবল আশাহত হয় ভক্ত, সেভাবেই হাসপাতালের কাঁচগুলোতে আঁচড়ে পরে রাগ। জমি বেচে, ফিক্সড ডিপোজিট বন্ধক রেখে চিকিৎসা করা মানুষ এর রাগ।

রাতের ঘুম এ মৃত রোগীর মুখ, হাত ক্রমাগত ধুলেও রক্ত, ঘেমো পেশেন্ট পার্টির কান্না, কোলে বাচ্চা নিয়ে বউ এর অশিক্ষা ভরা অভিশাপ। ডাক্তার বাবুরা নিশ্চিত এ সব দেখেন। আসলে নিজেরাও স্বীকার করেন না।

তাই হয়তো মদের দোকান এর ব্যাবসা থেকে কিছুটা আলাদা চিকিৎসা ব্যাবসা আর যে চিকিৎসক এই ব্যবসা তে সিদ্ধহস্ত তিনি চিকিৎসক নন চিকিৎসা শিল্পপতি। মৃত মানুষ কে ঠিক কতটা দোজ দিলে নড়ে চড়ে উঠবে ভিজিটিং আওয়ার এ, কতদিনের প্যাকেজ এ কাকে রাখা যাবে এরা সব জানে। জানতে শিখিয়েছে ব্যাবস্থা।

আসলে গলদটা বোধহয় এদের না। চিকিৎসক বা চিকিৎসা শিল্পপতি না হতে পারা লোকেদের। আমাদের। আমরাই কাঠামো তৈরি করেছি এমন যেখানে বিচারক আসে এম্বাসেডর চড়ে আর উকিল আসে মার্সিডিজ এ। মুহুরির নিদেনপক্ষে একটি বোলেরো। এবার এই বিচারক বিবাহিত,  বউ প্রতিরাতে আদর করার সময় উদাহরণ দেয় কোন উকিল কি কিনলো তার, বিচার ধুয়ে জজ সাহেব কে টেবিল এর তলায় গাড়ি কেনার টাকা টা নিতেই হয়।

যে মানুষ সারা জীবন প্র‍্যাক্টিস না করে মেডিকাল কলেজ এর প্রফেসর হয়ে থেকে গেলেন, তার মাইনে ছাত্রের গাড়ির তেল এর খরচা। গুটখা কোম্পানি কে হাসপাতাল তৈরি করার সুযোগ রাষ্ট্র দিয়েছে। আমরা সুবিধা করে দিচ্ছি। আর ডাক্তার দের মাইনে করা একজিকিউটিভ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বার এ। যেখানে পান এ পিক ফুলের টব এ ফেলে মালিক বাহাদুর বলে:
"কি ছিড়ছো? হচ্চে না ডাক্তার। কয়েকটা ভেন্টিলেটর দাও।"

আমার মা বাবা দুজনেই পেশায় চিকিৎসক। সরকারি হাসপাতালের জিপি। আমি সাংবাদিক।
আমার থাকার মধ্যে সাকুল্যে একটা স্কুটার, ভালো ভাবে থাকার জন্য জরুরি মধ্যবিত্ত যা কিছু।

মা বাবা চিকিৎসা শিল্পপতি হতে পারেনি। রোজ বাড়ি এসে মা রান্না করে। আমরা ডাল ভাত পাতলা মাছ খাই। আমার পেটের অসুখ, আলসার, অম্বল। মা ডায়াবেটিক, বাবার প্রেসার। যেরকম অন্যান্য বাড়িতে হয় আরকি। চিকিৎসা শিল্পপতি দের ও পেটের অসুখ, আলসার, অম্বল হয়। ডাল ভাত, পাতলা ঝোল খায়। কিন্তু বিভ্রম এ কখনো ডাল এ বাজে ওষুধ, কিডনি সেদ্ধ, পাতলা ঝোলে রক্ত দেখতে পায় যদি? সে বড় কঠিন অসুখ।

যে সমস্ত চিকিৎসক আজ ও জীবিত আর রোজ রোগ সারিয়ে তোলার তাগিদে হাসপাতালে ছোটেন, তারা শহরে রোগীদের কাছ থেকে খুশি মনে পারিশ্রমিক ও শ্রদ্ধা পান, গ্রাম এর সরকারি হাসপাতালে শ্রদ্ধা, অন্ধ বিশ্বাস আর বাড়ির সব্জি।

এদের দেখে আজ ও নতুন গল্প, নতুন খবরের তাগিদ এ অফিস যাই। যতই জাঙ্গিয়া কোম্পানির জনসংযোগ বাবু হওয়ার বিশাল অফার আসুক না কেন।

আমরা কেউ সৎ নই। যতটা থাকা যায় বিবেক এর কাছে আরকি।তবে কেউ যদি লাশ নিয়ে ব্যবসা বা বিশ্বাস নিয়ে মুরগি বানানোর পচা খেলায় মেতে ওঠে, হাসপাতালের বোর্ড পাল্টে "ক্যাওড়াতলা" লিখতে হয় বইকি। জনগনতান্ত্রিক বিপ্লব এটাই কি কমরেড?

---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

No comments:

Post a Comment