কবির কদর নেই জীবদ্দশায়, কবির কবর দেয়া হয় না।
থাকলে,এপিটাফ কদর দিত/কোন নিষিদ্ধ প্রেমিকার মতো।

mayukh speaks

My photo
kolkata, west bengal, India
A media professional and a wanderer by passion. Blogger and social observer. loves to watch world films and hear different music genre.

Saturday, February 25, 2017

| ওহ! ডাক্তার |

আমার মা বাবা দুজনেই পেশায় চিকিৎসক। সরকারি হাসপাতালের জিপি। রোজ ৬০০ রোগী আসে, টিকিট কেটে ওপিডি-তে রোগ নিয়ে লাইনে দাঁড়ায়। কখনো রাগে ফেটে পরে। কখনো বাড়ির সব্জি নিয়ে আসে ভালোবেসে। ভগবান তবে মাটির কাছাকাছি।

আমি ছোটবেলায় এসব দেখেছি। ছোটবেলার অনেকটা সময় আমি সোনারপুর হাসপাতাল কোয়ার্টার এ কাটিয়েছি। নার্স, আয়া মাসিমাদের মাঝে।

মা বাবা ছাড়া আমার বোন ও ডাক্তার হব হব করছে। আমি বাদে এরা সবাই ডাক্তার। আমি জয়েন্ট এ এমবিবিএস এ পাইনি। ডেন্টাল এ পেয়েছিলাম। একটি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ এ নাম ও লেখানো হয়েছিল। কিন্তু প্রথম সপ্তাহে যা বুঝলাম তা হল আজীবন আমায় পুরুষ ও মহিলার ঠোঁটের খুব কাছে থেকেও কেবল দাঁতের গন্ধ শুঁকে অর্থ উপার্জন করতে হবে। কারন আর যাই হোক আমি ভালো ডাক্তার হতে পারতাম না।

সেলসম্যান হয়ে রোগী আনতাম বটে। কায়দা, ঠাঁট ও শিখে নিতাম কিন্তু মন শায় দেয়নি। অভিনয় ও শোম্যানশিপ করতে হলে ডাক্তার সেজে কেন, অভিনেতা, নেতা বা নিদেনপক্ষে সাংবাদিক সেজে করবো। ডাক্তার তো রুগী দেখবে। পাশে থাকবে, বকা দেবে অশিক্ষা দেখলে, কাঁধে হাত রেখে হনহন করে হেঁটে চলে যাবে।

ছোটবেলায় স্কুলের বন্ধুরা ভাবতো ও বলাবলি করতো যে আমাদের নাকি বহু গাড়ি, সাত মহলা বাংলো বাড়ি, ৭৭ ডজন মায়ের শাড়ি ও আমার এক আলমারি খেলনা আছে। কারন আমার মা বাবা দুজন ডাক্তার। ডাক্তার দের এসব থাকে। তারা ওষুধ এর কাটমানি নেয়, অপারেশন করে কিডনি বের করে নেয় তবে তারা ভগবান। আমার লজ্জা লাগতো আর রাগ ও। বাস্তব এ এর একটা ও দেখিনি। থাকার মধ্যে সাকুল্যে একটা অল্টো গাড়ি, ভালো ভাবে থাকার জন্য জরুরি মধ্যবিত্ত যা কিছু। উচ্চাশা ছিল।

উচ্চাশা থাকা কি অপরাধযোগ্য? একজন ডাক্তার যে ১০ বছরভর মাথা গুজে শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, তার উপর আরো দক্ষ হওয়ার শিক্ষা, ক্লিনিক এ রোগী দেখা শেখে, তার কি শখ থাকতে পারেনা রোগী দেখে একটি টয়োটা কেনার?

একটি ফটকায় ব্যাবসা করা দালাল, ড্রেন তৈরির টাকা থেকে কাটমানি খাওয়া কাউন্সিলর ও স্কোরপিও চড়ে। আর ডাক্তার জ্যান্ত লোকের কল কব্জার ভার নিয়েছে।

এরপর এক দক্ষ এমবিএ পাশ কিছু ওষুধ কোম্পানি তাকে মার্সিডিজ এর স্বপ্ন দেখায়। কিচ্ছুটি করতে হবেনা। স্রেফ বিশেষ ট্যাবলেটটা লিখে যেতে হবে বা রোগীকে ভয় পাইয়ে টেস্ট করতে পাঠাতে হবে। নিদেনপক্ষে একটা আইসিইউ বেড এ পাঠানো। ডাক্তার এর কথায় সব হয়। ডাক্তার ভগবান।

কিন্তু ভগবানকে যেরকম মানুষ এর মত হাগু করতে দেখলে, চুমু খেতে দেখলে প্রবল আশাহত হয় ভক্ত, সেভাবেই হাসপাতালের কাঁচগুলোতে আঁচড়ে পরে রাগ। জমি বেচে, ফিক্সড ডিপোজিট বন্ধক রেখে চিকিৎসা করা মানুষ এর রাগ।

রাতের ঘুম এ মৃত রোগীর মুখ, হাত ক্রমাগত ধুলেও রক্ত, ঘেমো পেশেন্ট পার্টির কান্না, কোলে বাচ্চা নিয়ে বউ এর অশিক্ষা ভরা অভিশাপ। ডাক্তার বাবুরা নিশ্চিত এ সব দেখেন। আসলে নিজেরাও স্বীকার করেন না।

তাই হয়তো মদের দোকান এর ব্যাবসা থেকে কিছুটা আলাদা চিকিৎসা ব্যাবসা আর যে চিকিৎসক এই ব্যবসা তে সিদ্ধহস্ত তিনি চিকিৎসক নন চিকিৎসা শিল্পপতি। মৃত মানুষ কে ঠিক কতটা দোজ দিলে নড়ে চড়ে উঠবে ভিজিটিং আওয়ার এ, কতদিনের প্যাকেজ এ কাকে রাখা যাবে এরা সব জানে। জানতে শিখিয়েছে ব্যাবস্থা।

আসলে গলদটা বোধহয় এদের না। চিকিৎসক বা চিকিৎসা শিল্পপতি না হতে পারা লোকেদের। আমাদের। আমরাই কাঠামো তৈরি করেছি এমন যেখানে বিচারক আসে এম্বাসেডর চড়ে আর উকিল আসে মার্সিডিজ এ। মুহুরির নিদেনপক্ষে একটি বোলেরো। এবার এই বিচারক বিবাহিত,  বউ প্রতিরাতে আদর করার সময় উদাহরণ দেয় কোন উকিল কি কিনলো তার, বিচার ধুয়ে জজ সাহেব কে টেবিল এর তলায় গাড়ি কেনার টাকা টা নিতেই হয়।

যে মানুষ সারা জীবন প্র‍্যাক্টিস না করে মেডিকাল কলেজ এর প্রফেসর হয়ে থেকে গেলেন, তার মাইনে ছাত্রের গাড়ির তেল এর খরচা। গুটখা কোম্পানি কে হাসপাতাল তৈরি করার সুযোগ রাষ্ট্র দিয়েছে। আমরা সুবিধা করে দিচ্ছি। আর ডাক্তার দের মাইনে করা একজিকিউটিভ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বার এ। যেখানে পান এ পিক ফুলের টব এ ফেলে মালিক বাহাদুর বলে:
"কি ছিড়ছো? হচ্চে না ডাক্তার। কয়েকটা ভেন্টিলেটর দাও।"

আমার মা বাবা দুজনেই পেশায় চিকিৎসক। সরকারি হাসপাতালের জিপি। আমি সাংবাদিক।
আমার থাকার মধ্যে সাকুল্যে একটা স্কুটার, ভালো ভাবে থাকার জন্য জরুরি মধ্যবিত্ত যা কিছু।

মা বাবা চিকিৎসা শিল্পপতি হতে পারেনি। রোজ বাড়ি এসে মা রান্না করে। আমরা ডাল ভাত পাতলা মাছ খাই। আমার পেটের অসুখ, আলসার, অম্বল। মা ডায়াবেটিক, বাবার প্রেসার। যেরকম অন্যান্য বাড়িতে হয় আরকি। চিকিৎসা শিল্পপতি দের ও পেটের অসুখ, আলসার, অম্বল হয়। ডাল ভাত, পাতলা ঝোল খায়। কিন্তু বিভ্রম এ কখনো ডাল এ বাজে ওষুধ, কিডনি সেদ্ধ, পাতলা ঝোলে রক্ত দেখতে পায় যদি? সে বড় কঠিন অসুখ।

যে সমস্ত চিকিৎসক আজ ও জীবিত আর রোজ রোগ সারিয়ে তোলার তাগিদে হাসপাতালে ছোটেন, তারা শহরে রোগীদের কাছ থেকে খুশি মনে পারিশ্রমিক ও শ্রদ্ধা পান, গ্রাম এর সরকারি হাসপাতালে শ্রদ্ধা, অন্ধ বিশ্বাস আর বাড়ির সব্জি।

এদের দেখে আজ ও নতুন গল্প, নতুন খবরের তাগিদ এ অফিস যাই। যতই জাঙ্গিয়া কোম্পানির জনসংযোগ বাবু হওয়ার বিশাল অফার আসুক না কেন।

আমরা কেউ সৎ নই। যতটা থাকা যায় বিবেক এর কাছে আরকি।তবে কেউ যদি লাশ নিয়ে ব্যবসা বা বিশ্বাস নিয়ে মুরগি বানানোর পচা খেলায় মেতে ওঠে, হাসপাতালের বোর্ড পাল্টে "ক্যাওড়াতলা" লিখতে হয় বইকি। জনগনতান্ত্রিক বিপ্লব এটাই কি কমরেড?

---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

| প্রাপ্তবয়স্ক ভ্যালেন্টাইন |


সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কখন যেন বড় হয়ে গেছে। প্রস্টেট, হাঁপানি আর দাঁড়ানো' সর্বস্ব মাংস পিন্ড প্রেমে।

কখন যেন নিক্কো পার্ক এ বসে ভাগাভাগি করে ঠোঁট এ ঠেকানো স্ট্রবেরি আইসক্রিম বদলে গেল স্ট্রবেরি ফ্লেবার এ। কোল বালিশ জ্যান্ত হয়ে উঠলো পায়ের ফাকে।

গোলাপ ফুল যেটা বারান্দা থেকে ছুঁড়ে দিয়েছিল ও, তা বই এর মাঝে থাকতে থাকতে চ্যাপটা এখন, সে ও তো এক কন্যার মা, মুখ এ এখন ও জেল্লা আছে আর আছে অফিস, মেয়ের স্কুল, পাড়ার মুদির দোকান করার মাঝে ব্লাউজ এর খোপে ঘাম।

আর্চিস এর দোকানের থেকে কবে যেন Zivame-র ডিসকাউন্ট বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল আর কৈশোর এর এফ-টিভির 'লিংগেড়ি' যে আসলে 'ল্যঞ্জরে' তা জানা গেল।

বেপাড়ার সিডির দোকান থেকে ভাড়া করা যৌনতা বেওয়ারিশ হল, ফাকা ফ্ল্যাট এ প্রথম একলা যাপন এ।

এরই মাঝে কলেজ করিডর এর চুমু খাওয়ার রোমাঞ্চ বদলে গেল 'দাঁড়ানো' সর্বস্ব মাংস পিন্ড প্রেমে। আমি তৈরি হলাম। ভ্যালেন্টাইন কে জাপ্টে ধরলাম, মুখে উপহার দিলাম এসিডদগ্ধতা।

আমি। আমারই মতো আমরা। এসিড এর টিপ ভালো না হলে তুলে নিয়ে গেলাম। কাছ থেকে হাতিয়ে হাতিয়ে ভ্যালেন্টাইন এর শরীর জরিপ করলাম, মাঝরাতে অনেক ভালোবেসে ছুঁড়ে দিলাম ধানক্ষেতে। ওখানে হেডলাইট এর আলো পৌঁছোবার ব্যবস্থা আছে। নগ্ন 'শলীল'।

ভ্যালেন্টাইন কখন যেন আমার সাথে বড় হয়ে গেছে। একদিন গোলাপ এ, বাকিদিন সংবাদ শিরোনাম এ, মুখ ব্লার করে ঘটনার সমস্ত বিবরন টানা ক্যামেরার সামনে দিয়ে যাওয়া এক অভিযোগকারিনী।

আমাদের ও হয়তো মেয়ে আছে বা হবে। ভ্যালেন্টাইন হবে। সন্ধে নামার আগে বদল আসবে কবে?

----- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

| অপরাহ্ন |

ভালোবাসা ছিল না কখনোই/
দামি সুগন্ধি চাপিয়ে মেকি প্রেমিক সাজতাম দুজনে।

স্নান এর শেষে, বেরিয়ে আসতো বিন্দু বিন্দু রাগ-অভিমান/
আমি রোজ রাতে সুগন্ধি ঢাকা দিতাম ক্ষতে।

দামি ফুসফুস ফুরিয়ে যাবে একদিন/
বোতল এ হাওয়া ছাড়াও ওই যে দেখা যাচ্ছে আমাদের সিঁদুরদান।

ওটা ঢাকবে কিসে ?

-- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

| রোজ নতুন একজন বাংলা ভাষায় অনুপ্রাণিত হোক |

"এ রাত্তিরে দাঁড়িয়ে আছি এই টুকুনি আশায়/
লাশগুলো কাল কইবে কথা, আমার মাতৃভাষায়।"

আজ সারারাত লাশ গুলো আমার সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলবে। জব্বর, তাজুদ্দিন অহমেদ পায়চারি করবে সারারাত রক্ত মাখা পাঞ্জাবি গায়ে, মেঝেতে আঁকিবুঁকি কাটা হবে অ আ ই ঈ। আমার বাংলা হরফে।

আমার প্রথম চুমুর শব্দ, আমার মন খারাপ এর বিড়বিড়, আমার মায়ের রান্নাঘর এ গুনগুনিয়ে বেঁচে থাকবে অক্ষর মালা। বাংলা।

আমরা বাঙালিরাই বোধহয় বিশ্বের সবচেয়ে আত্মবিস্মৃত জাতি। এমন এক ন্যাতানো বেগুনভাজা যার সমস্ত সম্ভাবনা ছিল মুচমুচে হওয়ার কিন্তু হাতে থাকলো রুমাল আর জেলুসিল এ আভিমান।

বাঙালি বেঁচে থাকলো ক্যালকাটা ক্লাব এর টাই আর মেনল্যান্ড চায়নার চিংড়ি চাউমিন উইথ মালাইকারি আর ম্যান্ডারিন সস এ।

ঢেকুর এর শব্দ শুনে এক সময় বাঙালি চেনা যেত। বুড়ো আঙুল চেটে, শেষ পাতে দই আর জোয়ান এর আড়ক খাওয়া ঢেকুর। কান পাতলে শোনা যেত মন্ত্রচারণ এর মত এক সাথে অ এ আম, খ এ খেজুর।

এখন চেনা যায় ফেসবুক লাইভে "হাই ফ্রেন্ডস কেমন আছো তোমরা?" শুনলে। "নমস্কার বন্ধুরা" আজ সেকেলে। যেরকম সেকেলে টানা বাংলাতে কথা বলা।

কেন বাঙালির নিজের ভাষার প্রতি অহংকার করবে না, তাই নিয়ে একটা যাদবপুর এ হোক গবেষণা হয়ে যেতে পারে। গোটা বিশ্বে কোথাও নিজের ভাষায় কথা বলার দাবিতে কেউ হয়তো একটা গোটা যুদ্ধ লড়ে না। লড়বে না।

একটা গোটা দেশ তৈরি হল বাংলা ভাষাভাষী দের জন্য, আর সেই দেশেই হায় রবীন্দ্রনাথ পাঠ্যক্রম থেকে সরে গেল, বাংলার উর্দুকরন চালু হল।

আর এদিকে চালু হল নস্টালজিয়া ট্রিপ। রবি ঠাকুর, সত্যজিৎ এর পর যা এলো তা হাগু। দ-এ দেব নাকি হাস্যকর, শ্রীজিত এর ছবি বোগাস, শ্রীজাতের লেখা নাকি ছড়া কাটা। অথচ এরাই কিন্তু বাংলা ভাষায় নিজেদের কাজ ভালো বা মন্দ হোক করে চলেছে।

আর আমরা যারা এদের খিস্তি করছি তারা বাংলার বাইরে গিয়ে প্রথম কাজটাই করছি বাংলা ভুলে স্বপ্নটা হিন্দিতে দেখার, বাংলাতে কিছু বলা হলে, কোন শিল্প বাংলায় হলেই তা আঞ্চলিক তকমা লাগিয়ে দেওয়ার।

অনেকে তো আবার বাংলা বলে কিছু আছে সেটাই সারা বছরভর ভুলে থাকে। মাঝেমধ্যে মা এর আঁচল মনে পরলে ওহ! ক্যালকাটায় মেয়াওনিজ দিয়ে মোচার চপ আর দুর্গা পুজোয় ধুতি। ব্যাস! বাকি সময় বাচ্চা কে যুদ্ধকাকালিন ভাবে বাংলা থেকে দূরে রাখার কাজ, আর শেখানোর মধ্যে একটা দুটি হাট্টিমাটিমটিম। তাই সই।

যখন একজন বিদেশি তার নিজের বাচনভঙ্গিতে, উচ্চারণ এ ইংরাজি তে কথা বলে, আমরা কল সেন্টার এ বিশেষ ভাবে তা রপ্ত করি, কিন্তু যখন আমরাই আমাদের উচ্চারণ এ ইংরাজি বলি, তা হয়ে যায় ভুল। বেংলিশ।

ইংরেজরা চলিয়া গেলেও হায়, হ্যাংওভার রাখিয়া গেছে। তাই হয়তো কোলকাতাতেই ময়লা উর্দি পরা কোন রেস্তোরা শ্রমিক ইংলিশ এ কথা বলা খদ্দেরকে আদেখলা খাতির আর বাংলায় কথা বল্লেই, রুক্ষ বলুন কি লাগবে-র মাঝামাঝি কোথাও রাখে।

নিজের ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগে, ভবিষ্যৎ এ আমার সন্তান অ আ ক খ কে প্রাচীন কোন গুহা ভাস্কর্য ভেবে নেওয়ার আগে আসুন সামান্য কিছু করি। বাংলার জন্য। বাংলা ভাষার জন্য।

বেঁচে থাকুক ২১ ফেব্রুয়ারি আর মানুষ ১৯ মে এর সংগ্রাম ও জানুক।

চলুন না, বাংলা হরফ এ লেখা শুরু করি। এত কিছু তো ডাউনলোড করি, বাংলা ফন্ট ও না হয় রেখে দিই মোবাইল এ। হোক বা বানান ভুল, হোক না হোঁচট খাওয়া তবু আসুন নিজের ভাষায় লিখি। যে ভাষায় কথা বলি, সে ভাষায় কথার পিঠে কথা চাপিয়ে যাই। আমি কিন্তু শুরু করে দিয়েছি। আর একজন কে অন্তত অনুপ্রেরিত করেছি বাংলা তে লিখতে।

প্রেমে ব্যথা পেয়ে মেয়েটির মুখে এসিড ছোঁড়ার থেকে অনেক ভালো হাফসোল খাওয়া বাংলা কবিতা লেখা।

জয় বাংলা,
ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

| ওপাশ ফিরে দেখি কঙ্কাল জড়িয়ে পার্থ শুয়ে |


অবশেষে গল্পটা শেষ হল। শেষটা অনেকেই হয়তো এরকম হবে ভেবেছিল। একটা এসএমএস বা ফেসবুক পোল করলে হয়তো নব্বই শতাংশ ভোটার আত্মহত্যার পক্ষেই ভোট দিত।

পোড়া মাংস, মিকি মাউসের ছবি, দিদির কঙ্কাল, বাবার আগুন এ জ্বলতে থাকা চিৎকার, ইকো হয়ে চলা বয়স্ক বিশ্লেষক এর ইনসেস্ট তত্ত্ব।

স্বাধীনতার পর সবচেয়ে আলোচিত 'সাইকো' সংবাদ। "মাল শেয়ানা" সব ওর জন্যই হয়েছে। "আবার বিয়ে করবে বলছিল"। ঘরে মহিলা ঢুকলে কি কি বলেছিল?

লেখাটা লিখবো কি লিখবো না ভেবে অবশেষে লিখছি। লিখতে বাধ্য হচ্ছি কারন পার্থ দে অনেক গুলো মানুষের গভীর ঘুম নষ্ট করে চুল্লিতে ঢুকছে। ওপাশ ফিরে শুলে হয়তো পার্থর মুখ ভেশে উঠবে। আমাদের প্রধানত, যারা সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত। যারা এই পরিবার টা খুব কাছ থেকে দেখেছি, মুখস্থ করেছি এদের বংশ তালিকা, ঘটনাবহ।

প্রতিটা নিউজ স্টোরির পিছনে একাধিক স্টোরি থাকে। গল্প থাকে একাধিক পাওয়া বা না পাওয়ার। কিছু নিউজরুম এ চাপা পরে থাকে, কিছু ফিসফাস হয়ে প্রেস ক্লাবের দেওয়াল এ লেপ্টে থাকে।

সেই সময় আমি বাংলার একটি টিভি চ্যানেল এ কাজ করি। কোন একটি সাধারণ রাতে অফিসের কাছে রবিনসন স্ট্রিট এ একটি আত্মহত্যার খবর আসে। সাধারণ খবর, খবরের ভাষায় ভট। সাংবাদিক এর কাজ করে সাংবাদিক বাড়ি ফিরে আসে। ঘুমিয়ে পরে। কলকাতা জেগে ওঠে এক ভয়াবহ ভূতের গল্পে।

২০১৫ সালে রবিনসন স্ট্রিটে পার্থ দে’র বাড়ি থেকে তাঁর বাবার অগ্নিদগ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল। উদ্ধার হয়েছিল পার্থ’র দিদি দেবযানীর কঙ্কালও। এর পর প্রথমে হাজতে এবং পরে পাভলভ মানসিক হাসপাতালে দীর্ঘদিন কাটিয়ে পার্থ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিল। এসেছিল না ক্রমশ আরো জড়িয়ে পরেছিল তা বলার জন্য আর কোন চরিত্র বেঁচে নেই, কিন্তু যা বেঁচে থাকবে তা হল কিছু প্রশ্ন।

পার্থ মরা মানুষকে আগলে রেখেছিল তারা বেঁচে ফিরবে ভেবে। আমরা তাকে উন্মাদ, বিকৃতকাম তকমা দিলাম। অথচ সন্ত বা গুরুর দেহ আগলে ভক্তরা মাসের পর মাস যখন হোম, প্রার্থনা করতো, আমরা অলৌকিকতার আশা রাখতাম। ভাবতাম বাবা ফের ফিরে আসবে। ফুল, চন্দন, মধুর গন্ধে বাবা ফের আমাদের মাথায় হাত রাখবে।

পার্থ বাবাকে জ্বলতে দেখেও বাঁচাতে যায় নি। আমরা যেরকম মৃতপ্রায় বাবাকে ফেলে রাখি অন্তঃজলির আশায়। বা কোন বৃদ্ধাশ্রম এ।

পার্থ মৃত মানুষদের খেতে দিত। জল,ক্যাডবেরি, পছন্দের বই পাশে রেখে দিত। যদি দিদি ফিরে এসে এক কামড় দেয় খাওয়ার এ বা পছন্দের বই হাতে ওই চেয়ারটায় বসে? আমরা ও তো তাই করি। শ্রাদ্ধ, মৎসমুখীর নামে। পিণ্ডি দেওয়ার নামে। আমরা যারা সুস্থ।

আমরা শান্তি তে এপাশ ওপাশ করতে পারবো তো? আমরা যারা ইনসেস্ট এর তত্ত্ব দিলাম কঙ্কাল এর সাথে। আমরা যারা প্রবলভাবে যে গুলো গল্পে চেয়েছি, সেগুলো সেকরম ভাবে ঘটছে দেখে দারুণ ফেটে পরলাম উল্লাস এ? মশলা মাখিয়ে?

ধন্যবাদ পার্থ আপনাকে। একটানা একঘেয়ে খবর দেখতে দেখতে ক্লান্ত ও স্টার জলসা, জি বাংলা তে শাশুড়ি বউমা কাহনে নতুন টুইস্ট আনতে অক্ষম প্রডিউসারকে নতুন রসদ দেওয়ার জন্য। আমরা  পয়সা দিয়ে ভয় পেতে ভালোবাসি তাদের মনোরঞ্জন দেওয়ার জন্য। ভূত পরিক্রমা হবে এর পরে। লোক মুখে চক্রান্ত তত্ত্ব উঠে আসবে। পার্থকে সুইসাইড করতে ব্রেনওয়াশ করলো না তো তারা যাদের গোটা সম্পত্তি লিখে দিয়েছিল লোক টা?

একটা লোক ফ্ল্যাট এ পুড়তে থাকলো কিন্তু পাশের ফ্ল্যাট এ কেউ টের ও পেল না। পাওয়ার কথা ও নয় এই ব্যস্ত সময়। এগিয়ে চলার সময়। আসলে We all are hiding a skeleton in our closet. হয়তো।

আমার কোলবালিশ চেপে আজ রাতে পার্থ শোবে। গল্প শেষ। কঙ্কাল নেই। নোটে গাছ শুকিয়ে গেছে পচা গন্ধে। এই অসুখ আমাদের। পাগল এর মাথায় হাত বোলাবে কে?

বিদায়।

--- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

বেসরকারি হাসপাতালে

বাংলার বাইরে থাকলে মায়োপিক হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। উপর থেকে পুরোটা দেখতে পাওয়া যায়। খবরের ভিতরে না ঢুকে।

আজ মমতা বন্দোপাধ্যায় বেসরকারি হাসপাতালের বাবুদের সাথে যেটা করলেন, চ্যানেলের ক্যামেরা গুলো অন করিয়ে, হোক না সস্তা জনপ্রিয়তা, পাবলিক কিন্তু হেব্বি খাচ্ছে।

মমতা যত দিন যাচ্ছে, ধাড়ালো  হচ্ছেন। মানুষের পালস বুঝে ঠিক সময় ঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া বা নেওয়ার চেষ্টা করছি করছি ভাবটাও কিন্তু মানুষ এর মনে থাকে।

বিরোধীপক্ষ যদি নড়ে চড়ে না বসে এখনো তাকে কালিঘাট এর ময়না ভেবে থাকে, কেবল নস্টালজিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য আগাম অভিনন্দন।

Tuesday, February 14, 2017

| ভারত কি শুধু দিল্লি? |

ভারতবর্ষ মানে কি শুধু দিল্লি?  প্রজাতন্ত্র দিবস এর রাষ্ট্রীয় অভিবাদন  প্রতিবছর ঘুরে ঘুরে এই বিশাল ভারতের এক একটা শহর এ করা যায় না?

কালাহান্ডি, তাওয়াং, বুদগাম, কন্যাকুমারী, ছিটমহল এ আনা যায় না গোটা রাষ্ট্রকে? কেন প্রতি বছর ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরে কিছু খুচরো প্রতিনিধি নাচবে-কুদবে, প্রবল দেশোদ্ধার করতে টেম্পো সাজাবে?

ভাবুন না, এমন এক ২৬ জানুয়ারি, পল্টন সমেত রাষ্ট্র এসেছে পাল্টু দের বকুলবাগান মাঠে, ফি বছর যেখানে চরকের মেলা হয়। সেনা প্রধান, রক্ষামন্ত্রী, নাবিক, জওয়ান, রাষ্ট্রপতি কন্যা সমেত, ভিন্নদেশীয় অভ্যাগত, যুদ্ধ জাহাজ, ঘোড়সওয়ারি।

কিংবা ভাবুন, অরুণাচল প্রদেশ এর কোন অরণ্য ছোয়া গ্রাম এ প্রধানমন্ত্রী নেমে এসেছেন বায়ুসেনার হেলিকাপ্টার চেপে, টফি হাতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরর ছেলের জন্য। সেই ছেলে টা যে বন্দুকের নল এ খেলনা খুঁজেছে, বারুদ এর গন্ধে কেক আর দেশ বলতে মায়ের কোল।

ভারত কবে ভারত কে লাটিয়ান্স দিল্লীর বাইরে ভাবা শুরু করবে? সাত মহলা বাংলো বাড়ি, শুক্রবারের স্কচ, রাষ্ট্রদূত এর বাগান বাড়ির মেয়েছেলে, সেন্ট্রাল হল থেকে অট্টরোল, বামপন্থী সিগার এর গন্ধ গভীরতম সেমিনারে, রুপোর কাপে চা দেশের জিডিপি নিয়ে ভাবতে ভাবতে।

এই ভারতবর্ষ মৃদু হাততালি দেয় কুচকাওয়াজ দেখে, পিছনের সারিতে বসা দর্শক গলার কাছে পিন্ড পাকানো কান্না চেপে সিটি মারে, চিংকার করে। অনেক পিছনে। ক্ষমতা যেখান থেকে বসা শেষ করে সেখান থেকে। তাদের ও সামনের সারি ভাবতে শেখায় একই ভাষায় কথা, একই সুর এ গান, একই রকম হাসি, একটি মাত্র রাগ। বাকিটা ডিসেন্ট। কথায় বেয়ারা, দেশদ্রোহী, বাজে গান, কিম্ভুত ভাবধারানুসারী।

এই কিম্ভুত মানুষগুলো ধানক্ষেতে দেখা যায়, বরফ এ ভাই এর কবর খুঁড়তে দেখা যায়, ঘামের গন্ধ, পান্তা ভাত, মোটা কাপড় এর খুঁট এ দেখা যায়, কিছুটা ময়লা ও বাকিটা চোখের জল।

মণিপুর এর মেয়েটি যাকে রোজ কাপড় খুলে প্রমান করতে হয় সে মানব বোমা নয় সে ও ভারতীয়, সে ও তো প্রজাতন্ত্র।

রোদ-জল-বন্যা তে দু মুঠো চালের খোঁজে লড়াই করা "প্রজাতন্ত্র থেকে কিচ্ছু টি না পাওয়া" সমস্ত  পদ-দলিতই তো প্রজাতন্ত্র। কাঁটাতার এর কাছাকাছি থাকা মানুষগুলোই তো বোঝে কাঁটাতারের ক্ষত। তাদের যদি দেশ এর বুকে নিয়ে আসা হয়,ক্ষততে সাময়িক মলম পরে, কিন্তু যদি গোটা দেশটাই হাতে হাত রাখে প্রান্তিক হৃদয়ে?

আসলে সময়টাই বোধহয় গোলমেলে। বহুত্ববাদ খায় না মাথায় দেয়, তা গুলিয়ে দেওয়ার খেলা চলছে। কে কত দাঁত খিঁচিয়ে, চোখ রাঙিয়ে দেশবাসী কে বোঝাতে পারবে এক দেশ এ একই নিয়ম, একই ভাষার ব্যাবহার, একই বিশ্বাস।

শেষ পাতে থেকে যাচ্ছে প্রজা, ওই কাঁটাতার এর পাশে থাকা মানুষ গুলোর মত। মূল ভূখন্ড থেকে অনেক দূরে টিভি তে চোখ রেখে আপ্প্রান ভারতীয় হওয়ার চেষ্টায়।

বিউগল বাজছে, সন্ধ্যে নামছে, পতাকা যত্ন করে ভাঁজ করে নামিয়ে নেওয়া হল। ভারতীয় এক ঘর এবার রাতের খাবার খাবে। ভাত,ডাল, কাঁচা লংকা, শাক ভাজা, মুরগির ছাল ঝাল ঝাল আর শেষ পাতে দিনবদলের স্বপ্ন।

--- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

আশাবাদী রোদ্দুর

শীতকাল খোয়া গেছে/
বসন্ত গাছের গালে ইদানীং জেগে আছে রোজ।

অসুখ ঘুমতে গেলে/
ভোরবেলা দিয়ে যায় আশাবাদী রোদ্দুর-খোঁজ।

---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

| প্রাপ্তবয়স্ক ভ্যালেন্টাইন |

সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কখন যেন বড় হয়ে গেছে। প্রস্টেট, হাঁপানি আর দাঁড়ানো' সর্বস্ব মাংস পিন্ড প্রেমে।

কখন যেন নিক্কো পার্ক এ বসে ভাগাভাগি করে ঠোঁট এ ঠেকানো স্ট্রবেরি আইসক্রিম বদলে গেল স্ট্রবেরি ফ্লেবার এ। কোল বালিশ জ্যান্ত হয়ে উঠলো পায়ের ফাকে।

গোলাপ ফুল যেটা বারান্দা থেকে ছুঁড়ে দিয়েছিল ও, তা বই এর মাঝে থাকতে থাকতে চ্যাপটা এখন, সে ও তো এক কন্যার মা, মুখ এ এখন ও জেল্লা আছে আর আছে অফিস, মেয়ের স্কুল, পাড়ার মুদির দোকান করার মাঝে ব্লাউজ এর খোপে ঘাম।

আর্চিস এর দোকানের থেকে কবে যেন Zivame-র ডিসকাউন্ট বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল আর কৈশোর এর এফ-টিভির 'লিংগেড়ি' যে আসলে 'ল্যঞ্জরে' তা জানা গেল।

বেপাড়ার সিডির দোকান থেকে ভাড়া করা যৌনতা বেওয়ারিশ হল, ফাকা ফ্ল্যাট এ প্রথম একলা যাপন এ।

এরই মাঝে কলেজ করিডর এর চুমু খাওয়ার রোমাঞ্চ বদলে গেল 'দাঁড়ানো' সর্বস্ব মাংস পিন্ড প্রেমে। আমি তৈরি হলাম। ভ্যালেন্টাইন কে জাপ্টে ধরলাম, মুখে উপহার দিলাম এসিডদগ্ধতা।

আমি। আমারই মতো আমরা। এসিড এর টিপ ভালো না হলে তুলে নিয়ে গেলাম। কাছ থেকে হাতিয়ে হাতিয়ে ভ্যালেন্টাইন এর শরীর জরিপ করলাম, মাঝরাতে অনেক ভালোবেসে ছুঁড়ে দিলাম ধানক্ষেতে। ওখানে হেডলাইট এর আলো পৌঁছোবার ব্যবস্থা আছে। নগ্ন 'শলীল'।

ভ্যালেন্টাইন কখন যেন আমার সাথে বড় হয়ে গেছে। একদিন গোলাপ এ, বাকিদিন সংবাদ শিরোনাম এ, মুখ ব্লার করে ঘটনার সমস্ত বিবরন টানা ক্যামেরার সামনে দিয়ে যাওয়া এক অভিযোগকারিনী।

আমাদের ও হয়তো মেয়ে আছে বা হবে। ভ্যালেন্টাইন হবে। সন্ধে নামার আগে বদল আসবে কবে?

----- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ