রাত তিনটের সময় ঘুমানোর চেষ্টা করা হয়, ঘেমেচুমে এ পাশ ও পাশ হয়, ঘুম হয় না। সকাল সাতটায় উঠেছে শরীর, মন কোলবালিশ জাপ্টে তখনও।কানাইয়া উঠলো। বন্ধ চোখে, চেনা জায়গা হাতড়ে ফিটফাট হওয়া।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে, হঠাৎ পিছন থেকে একমুঠো আবীর মাখামাখি করে দিলো বোন, চেপে ধরে। আজ দোল। ওর যেতে হবে । রাই অপেক্ষায় আছে।
যেতে হবে শিয়ালদা স্টেশনে। আজ উবের ছুড়ি হাতে যাত্রী অপেক্ষায়। গলা কাটার জন্য ধন্যবাদ তাদের। রাই ফোনে ওলা app দেখে কোন গাড়ি নেই জানালো।
আজ দোল। আজ রাস্তা মাতাল ও বাইক আরোহীদের দখলে থাকে। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে, উবেরই ভালো। অগত্যা কানাইয়া চললো উবের চেপে।
রাই সেজেগুজে রেডি। আজ ট্রেনে বাড়ি ফিরবে ও। আয়ান, মানে ওর বর, যাকে আবার কানাইয়া prince charming বলে খ্যাপায় সে আছে রাজধানীতে, জরুরি কাজ আছে ওখানে। ওখান থেকে সোজা রাই এর বাড়ি। রাই এর মা খুব ভালো পোলাও আর কষা মাংস রান্না করে। মাংস মানে হাফিজ এর রেওয়াজি খাসি। রাইদের বাড়িতে মুরগি আজও নিষিদ্ধ। খেলে মাটিতে বসে খেতে হয়, গঙ্গা জলে ধুতে হয় মেঝে।
কানাইয়ার দাদু ওর নাম রেখেছিল কানাই ঘোষ। একে ঘোষ গোয়াল তার উপরে কানাই। স্কুল কলেজ এ চাট খেয়ে পাগলা হওয়ার জোগাড়। আজকাল কানাইয়া নামটা পাবলিক হেব্বি খাচ্ছে, কানাই হল কানাইয়া, যেরকম আফজল ও পায় শহীদ তকমা।
রাই এর দুটো গোপিনী উবের অব্দি রাইকে ছাড়তে এসেছিল। ঠান্ডা, শব্দহীন উবের এর ভিতরটা। দুজন দুজনকে দেখে প্রথম কিছু মিনিট কাটালো, তার পরের কিছু মিনিট হাবিজাবি কথা আর একে অপরের পিছনে লেগে, শেষ কয়েকটা মিনিট শক্ত করে একে অপরের আঙুল চেপে ধরে।
গৌর বঙ্গের ট্রেন আজ কম। হোলির কারনে বেশ কয়েকটি বাতিল ও হয়েছে। আজ যে ট্রেনে রাই যাবে, সেটি fast passenger। তবে প্রচুর ভিড় হয়। রুমাল ছুঁড়ে জায়গা দখল করতে হয়। বেশিরভাগই মফস্বলের দাপুটে মহিলা, কেউ কেউ রাই এর মত। নিষ্পাপ তবে তুখোড়।রাই এর চোখগুলো যেমন। মায়াবী অথচ ছোবল মারে যখন তখন।ছোবল খেয়েছে বহু, অবিচল রাই হেঁটে চলে গেছে। রাস্তাজোড়া হাফসোল, হাত কাটা।কানাইয়ার অবশ্য রাই এর টিকলো নাকটাও দারুণ লাগে। সে যাগ্গে!
সকাল দশটায় ট্রেন প্ল্যাটফম্ এ ঢোকার কথা ছিল, ভারতীয় রেলের কল্যাণে এল দশটা কুড়িতে। লেডিস্ এ একটা জায়গা কোনমতে পাওয়া গেছে কিন্তু রাই কিছুতেই ট্রেন না ছাড়া অবধি বসবে না। দরজার কাছে কানাইয়া ঠায় দাঁড়িয়ে। ট্রেন ছাড়ুক তার পর সে যাবে। আসলে বোধহয় আরো কিছুক্ষণ একসাথে থাকার বাহানা। বা জড়িয়ে ধরতে চাওয়ার। রাই নিজের থেকে জড়িয়ে ধরতে লজ্জা পায়, যেরকম লজ্জা লাগে ওর বেশকিছু কথা বলতে।
পাক্কা দশটা চল্লিশ এ ট্রেনটা নড়ে চড়ে উঠলো। আজ জানে কি জিদ্ না করো। আঃ হাঃ ফরিদা খানুমজী আর একবার প্লিজ গেয়ে দিন গানটা। ভিসা পেতে অসুবিধে না হলে এই শিয়ালদা তে আসুন না দিদি! কানাইয়ার মুখটা শুকিয়ে আছে। রাই ও দেখাতে চাইছে কিছু হয়নি তবে .......
অগোছালো ভাবে কানাইয়া রাইকে জড়িয়ে ধরে। গোয়াল বামুনের মিলন যেরকম হয় আরকি। কানাইয়া রাইকে প্রেম আর ভালোবাসার ফারাক বলেছিল একবার। প্রেমের প্রকার ও ব্যাখ্যা করেছিল। বাইপাসের ধারের বাতানুকূল ধাবাতে বসে হেসেছিল দুজনে, দুজনের দুঃসাহস ভেবে।
নিষিদ্ধ প্রেমের গল্প তৈরি হয়েছে বহু ওদের দামাল মূহুর্তগুলো নিয়ে। প্রিন্সেপ ঘাটের বাগানে রাতে বাইক ঢুকিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছেন? হাওড়া ব্রিজের উপর থেকে নিচে তাকিয়ে থেকেছেন অনেকটা সময়?
ট্রেনটা এখন অনেকটাই এগিয়ে গেছে। কিছুক্ষন পর নতুন কোন স্টেশনে ঢুকবে। পূর্বরাগ কি বসন্তের মতো জাগ্রত দ্বারে?
রাই বোধহয় এখন বসে আছে ট্রেনে। কানাইয়া হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরার ট্রেনে চেপে বসলো। এই ট্রেন দেরিতে ছাড়েনি। কামরা গুলো যদিও পুরো ফাঁকা। জানালার ধারে হোলির দিন বসা ও মুশকিল। দুমদারাক্কা রঙ ভরা বেলুন ছুঁড়ে মারে রেল লাইনের ধারে বাচ্চাগুলো।
খুব জলতেষ্ঠা পেয়েছে। একটা ফট্ জলওয়ালা ওপেনার দিয়ে বোতল গুলোতে আওয়াজ করে নিজের জানান দিচ্ছে। ইস! রাই ট্রেনে ওঠার আগে বলছিল, তেষ্টা পেয়েছে। জলের বোতল কিনবে ভেবে ও কানাইয়া কিনে দিতে ভুলে গেছিলো। জল উঠেছিল কিনা কে জানে। একটা ফোন করে দেখলে হতো। কি ভেবে কানাইয়া ফোনটা করলো না। একটানা কানে ফোন ধরে রাখতে ভালো লাগে না ওর।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ফট্ জলওয়ালাকে ডেকে একটা বোতল দিতে বললো। উফ! কিরকম একটা করছে ভিতরে। গলায় কিছু আটকে আছে বোধহয়।
ফট্ জলওয়ালা একটা চাইনিজ মোবাইল এ হঠাৎ তারস্বরে একটা গান চালিয়ে দিয়েছে।
" তুমসে মিলনে কো দিল করতা হয়"
পরবর্তী স্টেশন সোনারপুর। ট্রেন দুটো দূদিকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। নামতে হবে। কানাইয়া ফট্ জলে চুমুক দিলো।
শেষ। বা শুরু ।
No comments:
Post a Comment