কবির কদর নেই জীবদ্দশায়, কবির কবর দেয়া হয় না।
থাকলে,এপিটাফ কদর দিত/কোন নিষিদ্ধ প্রেমিকার মতো।

mayukh speaks

My photo
kolkata, west bengal, India
A media professional and a wanderer by passion. Blogger and social observer. loves to watch world films and hear different music genre.

Sunday, June 10, 2018

উড়ন্ত হাতি,ময়ূর আর যমের চিয়ার্স -মহুয়ার ইতিকথা

|উড়ন্ত হাতি,ময়ূর আর যমের চিয়ার্স -মহুয়ার ইতিকথা|

---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

জাতিস্মরের মত মহুয়া জন্ম থেকে জন্মান্তর ফিরে ফিরে এসেছে। ফিরে আসবে। কখনো হাতি বা ময়ূরের ঠোঁটে, কখনো মৃত্যু বা দেবতার ঠোঁটে, কখনো চাঁদনী রাতে শাল পিয়ালের মাঝে শুয়ে ঝিঝি শোনা আর আকাশ দেখা কোন ঠোঁটে। এসেছে দীর্ঘ চুম্বনের মতো। অনেককাল আগে এসেছে। প্রথমবার ডিস্টিল্ড হয়ে বোতলে পাওয়া যাচ্ছে। ফরেন লিকার হুঁশিয়ার।

সে অনেক হাজার বছর আগের কথা। এখন মধ্যভারতে যে অরন্য এলাকা গোন্ডা নামে পরিচিত সেখানে তখন নানা পশু, পাখির বাস। আকাশে বাতাশে মিষ্টি গন্ধ থাকে। ঝরনায় থাকে ঠান্ডা জল। গাছে গাছে ফল। ঘাসের ওপর ছায়া। এরকমই কোন এক সময় বনের রাজা নির্বাচন হচ্ছিল। সে ভীষণ লড়াই বনের কুরসি দখলের।

ভোটের শেষ ধাপে লড়ছিলো প্যাঁচা ও ময়ূর। টানটান লড়াই কিন্তু দুজনেই ভোট পেলো সমান সমান। এবার বনের রাজা বেছে নেওয়ার পালা। গোটা অরণ্য সিদ্ধান্ত নিলো বোকা হুলোমুখো রাতজাগা প্যাঁচা নয়, বরং ময়ূরকে রাজা বানানো হোক। দেখতে সুন্দর, সাথে আস্ত রাজসিংহাসনের মতো একটা পেখম ও আছে।

ময়ূর ভায়া ভোটে জিতে আনন্দে আত্মহারা। তার ওপর বৃষ্টি নামলো ঝমঝমিয়ে। কাছা খুলে...ইয়ে মানে পেখম মেলে সেলিব্রেশন শুরু করলো। সারা রাত নাচ এক প্রাচীন মহুয়া গাছের তলায়। নাচের চোটে ঝুম ঝুম করে মাটিতে পরতে থাকলো মহুয়া ফুল। বৃষ্টি, ঝোড়া হাওয়া, মাতাল করা মহুয়ার গন্ধ, রসের স্বাদ পাগল করে দেয় ময়ূর সাহেবকে। দিনক্ষণ ভুলে লাট হয়ে পরে থাকে গাছের ছায়ায়।

ওদিকে রাজ্যাভিষেকের লগ্ন সমাগত। সবাই উপস্থিত ময়ূরকে রাজা হিসেবে দেখবে বলে। কিন্তু ময়ূর কই? কোথাও খোঁজ নেই। নেই নেই কোথাও নেই। মহা ফ্যাসাদে পরলো বাকিরা। খুব বিরক্ত হয়ে শেষে প্রস্তাবিত হলো যে সংখ্যালঘু প্যাঁচাকেই রাজা বানানো হোক। ওই কুমারস্বামী যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রী হলো আরকি। সাথে আদেশ জাড়ি হলো সেই শত্রুকে খোঁজার যার কারনে ময়ূর সারারাত বুঁদ হয়ে থাকলো।

এরপর শোনা যায় মহুয়া জীব ও জন্তুদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয় হয়। বীজ থেকে তেল, ফল থেকে আচার, ফুল থেকে মদিরা, খোসা থেকে সবজি, পাতা থেকে কাপড় বানাবার পদ্ধতি আবিষ্কার হয়। কলাগাছের মতই মাথা থেকে পা অবধি সবটাই কাজে আসে। কেবল সুরা নয়। এ জীবনযাপনের অংশ হয়ে ওঠে যুগে যুগে।

মর্ত্যলোকের এই 'মদবৃক্ষ' দেবতাদের ও নজরে আসে। আমি তখনকার কথা বলছি যখন বিশ্বাসে মিলানো হতো বস্তু। মানুষ ম্যাজিকে বিশ্বাস করতো, রুপকথার গল্প শুনতো, চমৎকারে ভরসা রাখতো। এরকমই এক চমৎকার ঝকঝকে সকালে  দেবতারা উড়ন্ত হস্তি চেপে হাওয়া খেতে বেড়িয়েছিলো। আজ্ঞে! সেসময় হাতি আকাশে উড়তে সক্ষম ছিল। ইয়া বিশাল বিশাল হাতি সব দেব দেবতাদের ফেরি করে বেড়াতো এই লোক থেকে ওই লোক।

পূর্ব ভারতের বায়ুপথ ধরে যেতে যেতে এক ক্লান্ত দেবতা ও তার বাহন ঠিক করলো একটু মাঝপথে জিড়িয়ে নেবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কিন্তু কেলো করলো তার পোষা হাতি। মাঠভরা ফসল, গাছ ভরা আঁখ দেখেই সে হাবাতের মতো ঝাপিয়ে লুটোপুটি খেলো। ক্ষেতের মাঝেই ছিলো এক মহুয়াগাছ আর হাড়িতে রাখা পানীয়। গলা ভেজাতে হাতি চোঁ চোঁ করে মেরে দিলো গোটাটা। ব্যাস! সে ভয়ানক নেশা। মাতালামো শুরু হলো। লাপটে আর সাপটে খেলো ক্ষেত উজাড় করে। ডিগবাজি খেলো, স্কিট খেলো, মহুয়া গাছে দোল খেলো গোটা দুপুর।

ফিউরিয়াস গ্রামবাসী দেবতাকে ঘিরে ধরলো। বিহিত করুন নয়তো দৈবগুনে ফসল ফিরিয়ে দিন। হাতির মহুয়ায় নেশা লেগেছে, এ ব্যাটা ফিরে ফিরে আসবেই আবার ক্ষেত উজাড় করতে। দেবতার লজ্জায় মাথা কাটা গেলো। রেগে সে হাতির দু কান ধরে দিলো আছাড়। হাতি দু ভোল্ট খেয়ে তখনো মুচকি মুচকি হাসছে। নেশা মোটেও কাটেনি। ক্ষুব্ধ দেব হাতিকে অভিশাপ দিলো যে এরপর আর কোনদিন সে উড়তে পারবেনা। পাশাপাশি আজীবন যাতে তার এই অপরাধবোধ থাকে, সে হেলতে দুলতে চলবে শুধু। চঞ্চলতা ছিনিয়ে নেওয়া হলো তার থেকে। রেখে দেওয়া হলো ঝিমিয়ে থাকা মুখ, মুচকি হাসি আর স্থবিরতা। হাতি আজ ও উড়তে পারেনা। রেড বুল খেলে ও না। তবে মহুয়া খাওয়া ছাড়তে পারেনি ও।

আজকের উড়িষ্যা বা উৎকলদেশে মহুয়া দিয়ে যমকে সন্তুষ্ট করা হয়েছিলো। বোকা ও বানানো হতো। যম বলে কথা। কোন ভেজাল বা চোলাই তো দেওয়া যায় না তাই শ্রেষ্ঠতম সুরা পরিবেশন করতে হয় বোকা বানাতে গেলেও। কথায় আছে, একবার যমরাজ মৃত্যুদূতকে বলেছিলো কোন এক কাঠ মিস্ত্রিকে নিয়ে আসতে। মৃত্যুদূত খেয়ে দেয়ে পৃথিবীতে ল্যান্ড করে দুপুরবেলা।

তখন মৃত্যুদূত হলেও নিয়ম না খাইয়ে ঘর থেকে না ছাড়া। ওখানকার লোক তো খাইয়েই ছাড়বে। সাথে আবার দিয়েছে এক ভান্ড মহুয়া। নেশা ফেশা করে মৃত্যুদূত এলো এক ভুল লোককে যমালয়ে নিয়ে। যমরাজ খোঁচে বোম। ভাগ্যি বোগলে করে এক ক্যানেস্তারা মহুয়া এনেছিলো। তা খেয়ে শরীর মন ঠান্ডা হলো যমের। চিয়ার্স করে বলেছিলো নাকি, মহুয়া মৃত্যুকে ও ফাঁকি দিতে পারে যদি সঠিক পেগ বানানো হয়। আজ ও নাকি মৃত্যু সামনে এলে তাকে বসাতে হয়। দাবা খেলতে হয় দু পাত্তর খেতে খেতে। কে জানে মন বদলালে ও বদলাতে পারে মৃত্যুর জীবনের উল্লাস দেখে, কাঁচে কাঁচে ঠোকা লেগে জন্মানো শব্দ শুনে।

এহেন ইতিহাস, লোকগাথা, পুরাণ, কল্পকথা মেশানো এক সুরা কেবল ফারমেন্টেশনে হয়না। এতে আদর মেশাতে হয়, প্রকৃতির ভালোবাসা, কাঠের উনুনের ওম, হাড়িতে ফেলে রাখার অবহেলা মেশাতে হয়। তবে গিয়ে বোতলবন্দি হয় প্রযুক্তিগুনে।

যে সুরার যোগ্যতা ছিলো ভটকা, কনিয়াক, শেরি,শ্যাম্পেন, জিন, মারটিনি, মালিবুকে দশ গোল দেওয়ার তাকে সেঁধিয়ে দেওয়া হলো প্রত্যন্ত এলাকার কোন প্রান্তিক মানুষের রসনারুপে। এটা নিঃসন্দেহে ব্রিটিশদের কাজ। কেউ প্রতিবাদ করেনি। কেউ কথা রাখেনি একগেলাসি বন্ধুত্বের।

ফেলিক্স প্যাডেল সাহেব যিনি আবার চার্লস ডারউইনের বংশধর তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে এদেশে এসেছিলেন। মহুয়া চেখে আর একগুচ্ছ ব্যাবসাদার সাহেবের মতো শত্রু চিনতে পেরেছিলেন। মহুয়ার মতো একাধিক সুরা এদেশে বানানো হয়। এগুলোকে বাণিজ্যিক ভাবে একবার যদি বাজারে আনা হয় তবে হার ম্যাজেস্টির ধান্দা চৌপাঠ হয়ে যাবে। সুতরাং নিষেধাজ্ঞা জারি করো, বিপুল ট্যাক্স বসাও আর এর ফাঁকতালে ভারতে ছেয়ে ফেলো ফরেন লিকার দিয়ে।

ব্রিটেনের স্কচ উইস্কি জায়গা করে নিলো ভারতের সৌখিন ড্রইংরুমগুলোতে আর মহুয়া ক্রমশ প্রান্তিক হলো। ঠেলে ঠেলে গভীরতর কোন কোনে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। যেখানে সভ্যতা স্বীকৃতি দেয়না একে বাবুদের পানশালায়।

মুম্বাই ও গোয়াবাসী বন্ধুবর ডেসমন্ড ন্যাজারথ অনেকদিন ধরে নিজ উদ্বোগে বিভিন্ন সুরা ব্রিউ করেন। ডিস্টিল করেন, বোতলবন্দি করেন। ভারতের এ কোন ও কোনে লুকিয়ে থাকা সুরার প্রণালী মূলস্রোতে নিয়ে আসেন নেশায় চাপিয়ে। উগ্র জাতীয়তাবাদের যুগে ডেসমন্ড গুরু দায়িত্ব নিয়েছেন মহুয়াকে বোতলবন্দি করে Reverse colonisation এর।

অনেক উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির ড্রইংরুমে মৃদু আলো, নরম সোফা, দামী স্টিরিও থেকে আসা সুর শুনেছি একবোতল মহুয়া বদলে দিতে পারে মাদলের তালে। সোফা বদলে যেতে পারে শাল পিয়াল আর ঝড়ে পরা মহুয়া ফুলের নরম বিছানায়। এক আকাশ তারা, অনেক ওপরে তারা, তার ওপর থেকে কালোরঙ ভেদ করে কোন উজ্জ্বল নক্ষত্রাদি। মাদল বাজছে। আগুনে ঝলসানো হচ্ছে মাংস। উড়ন্ত হাতি,ময়ূর আর মৃত্যুদূত গোল হয়ে বসে। আপনার আর মহুয়ার ওই বোতলের পাশে। চিয়ার্স!

©------ ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

তথ্যসূত্র ও সহায়তা: Desmond Nazareth

No comments:

Post a Comment