কবির কদর নেই জীবদ্দশায়, কবির কবর দেয়া হয় না।
থাকলে,এপিটাফ কদর দিত/কোন নিষিদ্ধ প্রেমিকার মতো।

mayukh speaks

My photo
kolkata, west bengal, India
A media professional and a wanderer by passion. Blogger and social observer. loves to watch world films and hear different music genre.

Friday, June 22, 2018

হারমোনিয়াম দাদু, ক্যাসেট কাকু আর গানওলাদের গল্প

| হারমোনিয়াম দাদু, ক্যাসেট কাকু আর গানওলাদের গল্প |

©------ ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

তখন হারমোনিয়াম রোদে দেওয়ার রেওয়াজ ছিলো। সন্ধেবেলায় গলা ছেড়ে গানের ও রেওয়াজ ছিলো।অনেক বাড়িতেই তানপুরা থাকতো ঘরের কোনে। বাটিক প্রিন্ট কোন কাপড়ে ঢাকা থাকতো সময়াভাবের ধুলো আটকাতে। পাশেই নতুন কেনা টেপডেকে পূর্বা দাম আর নচিকেতা সমানতালে চলতো। অনেক বাড়িতে তবলা ও ছিল। ধা ধিন্ ধিন্ তা না তিন তিন তা। হাত পাকলে বাবা 'সুরবিতান' থেকে বাঁয়াটা পিতলের নিয়ে আসতো। মাটির তানপুরা বা তবলা দেখলেই ওপর থেকে ধপাস করে ফেলে দিতে ইচ্ছে করতো আমার গরমের ছুটিতে। ওই আমলকি গ্রামের রাজার মতো, যে রেগে গুপি গায়েনের মাটির তানপুরাটা ফেলে ভেঙে দিয়েছিলো। 'সুরবিতান' এ মৃত বাদ্যযন্ত্র ও আবার সুরে বলতো নাকি। বৃদ্ধ মালিকের তাই দাবী ছিল।

গরমের ছুটিতেই তো ক্যাসেটের বাক্স পরিষ্কার করতে হতো। বাটা থেকে জুতো কিনলেই বাক্স ফ্রি। মার্বেল পেপার দিয়ে সাজিয়ে বাক্সতে তুলো বিছানো হতো। তারপর এক এক করে ক্যাসেট সযত্নে রেখে দেওয়া। ওপরে লিখে রাখা: ডোন্ট টাচ ময়ূখ ঘোষ সং বক্স। হিন্দির আলাদা বাক্স, ইংলিশের আলাদা, মায়ের রবীন্দ্রসংগীত এর আলাদা। বাবার কি সব ছাইপাঁশ গণসংগীত, দ্রোহের গান, ব্রিগেডের বক্তৃতার ক্যাসেট ছিলো। ঠাঁই পেতো না আমার এলিট বাক্সে। ওসব এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো। হলদে হয়ে যাওয়া লালচে ফাইল, ফেস্টুন, চেন ফ্ল্যাগের মতো।

ভবানীপুরে এক মোটা চশমা, শীর্ণকায় দাদু বসতেন 'বাজনার' দোকানে। ও দোকানের মেঝেতে মোটা ধুলোর আস্তরণ থাকতো হরবখত। আর দেওয়াল জুরে বাদ্য। শোনা যায় ওসব ধুলো আর বাদ্য বিশ্ববরেণ্য সুরকার, গায়কদের। তাই সাফ হতো না। বদলে যেত না সিন্থেসাইজারে।

শিল্পীর স্টুডিওর মতো কারিগর আসতো সব ওই বালব লাগানো একখান দোকানে। নিঁখুত হাতে সুরযন্ত্র বানানো হতো। হারমোনিয়ামের  কাঠ সাধারণত শেগুন ও বার্মাটিকের হতো।হারমোনিয়ামের যে অংশ দিয়ে ভেতরে হাওয়া ঢোকানো হয়, তার নাম বেলু। এই বেলু তৈরিতে কাঠের সঙ্গে চৌকোনাভাবে এঁটে দেওয়া হতো পিসবোর্ড। যাকে আমরা রিড বলি। প্রস্তুতকারকদের কাছে তার নাম পর্দা। এর নিচেই থাকতো স্প্রিং। রিড বা পর্দা হয় দুই স্তরে সাজানো ৩৭ ও ৪২ ঘাটের। রিড নিয়ন্ত্রণ করে বাঁশিকে। প্রতিটি বাঁশি পিতলের পাতলা আবরণে রিডের প্রতিটি ঘাটের সঙ্গে সংযুক্ত করা থাকতো। কাঠামো তৈরির পর দেবীর চক্ষুদানের মতো কঠিন কাজ থাকতো সুর টিউনিং করা। ওর ওপরই নির্ভর করতো মান। আর যন্ত্র দাদুর দোকানের ইজ্জত।

এরপর দীর্ঘ ছায়াপথ হেঁটেছে সুর। ইলেকট্রিক গিটার, ডিজিটাল কী বোর্ড, পিয়ানো একার্ডিয়ান সবই পাল্টে ডিজিটাল হয়েছে, আই টিউন হয়েছে। দোকানটাও বোধহয় আশেপাশের সিনেমাহলগুলোর মতো বন্ধ। দাদু তো ছবি আর স্মৃতিতেই সুখের। শুধু কয়েকটি বাদ্যের পরিবর্তন হয়নি আজ ও। যেমন ঢোল, খোল, তবলা, বেহালা, হারমোনিয়াম, হারমোনিকা বা মাউথ অরগ্যান। খুব বেশী টক্কর দিতে পারছেনা ডিজিটাল যুগে কিন্তু  সুরের যন্ত্র প্রযুক্তিতে যতই আধুনিক হোক সপ্তসুর ও পঞ্চবোল ছাড়া কোন কিছুই সুরে বাজানো যায় না। কান্না ও না।

কান্না তো ভীষণ পায় আমার যখন প্রাণের থেকেও বেশী প্রিয় ক্যাসেট কাকুর দোকানের পাশ দিয়ে যাই। গোটা দোকান ভেঙে কিম্ভুত নামের এক শাড়ীর শোরুম হয়েছে। ওখানে গান বাজে না। স্টার জলসা চালানো থাকে। ক্যাসেট কাকুর কোত্থাও নেই। অথচ ওখানেই তো বলে আসতে হতো একটা ব্ল্যাংক ক্যাসেট ধরিয়ে আমার পছন্দের প্লে লিস্ট। এপিঠ ওপিঠ মিলিয়ে ২০টা গান কপি করে দিতো কাকু।

ওই দোকানেই তো এ.আর.রহমানের ক্যাসেট দেখলেই কিনে ফেলা। ফিলিপ্স এর হেড ক্লিনার কিনতে যাওয়া ছ'মাস অন্তর। প্রতি ভাইফোঁটাতে বোন আর দিদিকে নতুন যে ক্যাসেট এসেছে বাজারে তার এক কপি উপহার দেওয়া। বাচ্চাদের জন্য রত্না সাগরের নার্সারি রাইমস এর ক্যাসেট আর সোনাদাদুর জন্য ইয়ানি বা বিসমিল্লাহ র সানাই। কাজী সব্যসাচীর আবৃতির ক্যাসেট ও মাস্ট ছিলো। কান সেট করতে হতো। ক্যাসেট কাকু সব গান নিজে শুনে নিতো। না হলে ভালো ক্যাসেট বেচবে কিভাবে!

কান্না তো ভীষণ পায় আমার যখন প্ল্যানেট এম বা মিউজিক ওয়ার্ল্ড ঢুকবো ভেবেও ঢুকতে পারিনা। ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যাসেট, সিডি পরখ করতে পারিনা। ফ্রিতে নতুন নতুন গান কানে দামী হেডফোন গুঁজে শুনতে পারিনা। রোজ আসতে আসতে আমি, আমরা ওই নতুন গানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখবো বলে গানওলাদের মেরে ফেলেছিলাম।

মুম্বাই থাকাকালীন স্বপ্নের গায়কদের মুখোমুখি হয়েছি অনেকবার। ৯০' কাঁপানো নাম সব। বাড়িতে লজঝড়ে মার্সিডিজ আর পেল্লায় সব শোকেজ। গোল্ডেন হিট, প্ল্যাটিনাম ডিস্ক, ফিল্মফেয়ার, নস্টালজিয়া। চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় কে শানু, কে উদিত বা অভিজিৎ, কে সোনু বা শান কিংবা কবিতা ও ইয়াগনিক। কান্না তো ভীষণ পায় যখন এদের ব্যস্ততা বলতে মফস্বলের শো, রিয়েলিটি টেলিভিশন আর এদিক ওদিক ফিতে কাটা বোঝায়। কে বলবে এদেরই অনেকে একদিনে বারো চোদ্দোটা গান রেকর্ড করতো। একমাসে ডিসপ্লে ফাঁকা হয়ে যেত ক্যাসেটের দোকানের। জলসাঘরের ছবি বিশ্বাসের মতো আজ ও 'কাজ পেতে হাত পাতবো না' জেদ নিয়ে বেঁচে আছে এরা। স্টেজে উঠলেই ম্যাজিক। সুড়ুত করে নব্বই এর দশকে চলে যাই আর ফাংশন শেষ হলে ভেউভেউ করে কাঁদি।

সিডি, আইটিউন, ডাউনলোডস, পাইরেসি বাঘবন্দি খেলার মতো ঘিরে ফেলেছিলো আমার হারমোনিয়াম দাদু, ক্যাসেট কাকু আর গানওলাদের। ওরা গলা ছেড়ে আর্তনাদ করছিলো।  আমরা নয়েজ কারেকশন হেডফোন কানে এতোটাই মশগুল ছিলাম হানি শিং এ, শুনতে পাইনি।

হারমোনিয়াম দাদু শেষদিন অবধি সৎ ভাবে দেশীয় বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করে গেছে। সিন্থেসাইজারের কথা উঠতেই বলতো, বাজার থেকে কেনা আদা রসুনের পেস্ট আর শিলনোড়ায় বাটা কি এক হলো? বাজিকরের ডুগডুগি, যাত্রাপালার হারমোনিয়াম, সার্কাসের জোকারের ঘুঙুর, লাঠি খেলার ‘নাকারা’, পালাগানের দোতারা, খমক, মৃদঙ্গ, কঙ্গ, বঙ্গ, সানাই, তুরি, বেনু, করতাল, মন্দিরা, ঘণ্টা, সেতার- শেষদিন অবধি আগলে রেখেছিলো।

ক্যাসেট কাকু শেষদিন অবধি পাইরেটেড সিডি ঢুকতে দেয়নি দোকানে। দাঁতে দাঁত চেপে ওরিজিনাল সিনেমা আর গান বেচে গেছে বাঁধা খদ্দেরদের। একসময় পেনড্রাইভ দেখলে ও মাথা গরম করে ফেলতো। বিশাল সমুদ্র থেকে মগ দিয়ে জল বের করতো। ভেজাল বাদ দিয়ে নিখাদ শব্দ বিক্রি করতে চেয়েছিলো শেষদিন তক।

গানওলারা আজ ও কেউ দেখুক ছাই না দেখুক, কালো চশমা পরে ঘোরে। অটোগ্রাফ চাইলে নামটাও জেনে নিয়ে দুলাইন লিখে দেয়, পুরনো গান চলতে দেখলে সিগারেট এ একটা দীর্ঘ টান দিয়ে, রিং ছেড়ে বলে বসে: "ময়ূখ তুমি তো সেন্সিবল, সাংবাদিক।  Class আর Crass এর পার্থক্য টা করতে শেখো।"

©------ ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

No comments:

Post a Comment