কবির কদর নেই জীবদ্দশায়, কবির কবর দেয়া হয় না।
থাকলে,এপিটাফ কদর দিত/কোন নিষিদ্ধ প্রেমিকার মতো।

mayukh speaks

My photo
kolkata, west bengal, India
A media professional and a wanderer by passion. Blogger and social observer. loves to watch world films and hear different music genre.

Saturday, June 23, 2018

আজ শনিবার, আজ নবারুণের জন্মদিন

| আজ শনিবার, আজ নবারুণের জন্মদিন |

--- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

আজ শনিবার।  আজ শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুদিন। আজ আওয়ামি লিগের ৬৯ বছর বয়স হলো। আবার আজ নবারুণ বেঁচে থাকলে এরকম এক শনিবার তার বয়স হতো ৭০। প্রজাতন্ত্রের বয়স হয়েছে ৭১। ফ্যাতারুদের বয়স হয়না।

আজ শনিবার। আজ কিচ্ছুটি না করে ঘুমোতে যান। কাল ভাত মাংস খান। তারপর এসি চালিয়ে বউ এর হামি, তারপর ইস্তিরি করুন কর্পোরেট হোয়াইট কলার। পাট পাট। কাল বাদে পরশু অফিস আছে। তারপর আছে বিশ্বকাপের কোন ম্যাচ। তার ও পরে দুর্গাপূজো বা ঈদের খুশী। মাঝে অবশ্য ম্যান্ডেটারি দাঙ্গা বাঁধবে কিছু হরিজন বস্তিতে বা হাজিপাড়ায়- আপনি শান্তিজল ছেটাবেন হেলিকপটার থেকে, তারপর মাংসপোড়া গন্ধ ভুলে আপনি হয়তো আইপিলে মজে যাবেন বা শপিং মলে।

আজ শনিবার। মলে যান। গরম গরম কেএফসি চিকেন, স্টাউট বিয়ার, ফিঙ্গার চিপস খান আজ। এরমাঝে সময় পেলে টিভি খুলুন এসি চালিয়ে। সুন্দরী পাঠক বলবে দেখুন বারবেলার বুলেটিনে এক্ষুনি:

" নমস্কার, এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় খবর। আজ শনিবার গোটা দেশজুড়ে কিছু পোড়-খাওয়া মারমুখী উড়ুক্কু জনগণ ফ্যাৎ ফ্যাৎ সাঁই সাঁই করে উড়তে থাকে। যাদের উইক অফ তাঁদের টাকে চাপড় মেরে সোজা বসের কেবিনে ঢুকে যাচ্ছে বলে খবর আসছে। স্বৈরাচার আর অন্ধকার দূর করে বিপ্লবী হ্যাজাক হাতে বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে ওদের। কাল রবিবার বলে কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঁঠার মাংস না খেয়েই কপ্তারে চেপেছে। শোনা যাচ্ছে মাঝ আকাশে ভেদবমি হয়েছে কিছু জনের। তবু ও অটল।

শোষণ, পরাধীনতা, গ্লানি, জোচ্চোরি, মানুষে মানুষে তীব্র বিভেদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে এরা। ইয়ে মানে পাড়ার শনি মন্দিরের সামনের পার্টি অফিসেই লিফলেট বোম্বিং করে।

শোনা যাচ্ছে এদের কাছে Weapons of Mass Destruction আছে আরো। সচিবকূল তড়িঘড়ি আর্জেন্টিনা গোছের এক বিল্ডিং এ ফিরে এসেছেন। আইবি রিপোর্ট দিয়েছে।

এদের কাছে মারণাস্ত্র আছে। পচাজলের বোম্বাচাক। বোঁদপড়া ডোবার জল যাতে পোকামাকড়, জার্মস থিকথিক করছে। কাক শকুনও ধারে বাড়ে যাবে না তা পিচকিরি দিয়ে বেলুনে ঢুকিয়ে গিঁট দিয়ে বেঁধে জলবোমা বানিয়েছে এরা। বারবেলা যুদ্ধ বাঁধাবে বলে।

সাথে ম্যাথরেরা এনেছে ঢ্যালা ঢ্যালা মানুষের গু আপনার কর্পোরেট স্পা করা টাকে, সৌখিন জামায় সব দেখে ও না দেখার ভান করে চলা বিবেকে ছুঁড়বে বলে। বুম!

আজ গুরুর জন্মদিন বাওয়া!  একটু Anarchy না করলে কি আর বার্থডে সেলিব্রেশন হয়? হিক!

©---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

Friday, June 22, 2018

হারমোনিয়াম দাদু, ক্যাসেট কাকু আর গানওলাদের গল্প

| হারমোনিয়াম দাদু, ক্যাসেট কাকু আর গানওলাদের গল্প |

©------ ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

তখন হারমোনিয়াম রোদে দেওয়ার রেওয়াজ ছিলো। সন্ধেবেলায় গলা ছেড়ে গানের ও রেওয়াজ ছিলো।অনেক বাড়িতেই তানপুরা থাকতো ঘরের কোনে। বাটিক প্রিন্ট কোন কাপড়ে ঢাকা থাকতো সময়াভাবের ধুলো আটকাতে। পাশেই নতুন কেনা টেপডেকে পূর্বা দাম আর নচিকেতা সমানতালে চলতো। অনেক বাড়িতে তবলা ও ছিল। ধা ধিন্ ধিন্ তা না তিন তিন তা। হাত পাকলে বাবা 'সুরবিতান' থেকে বাঁয়াটা পিতলের নিয়ে আসতো। মাটির তানপুরা বা তবলা দেখলেই ওপর থেকে ধপাস করে ফেলে দিতে ইচ্ছে করতো আমার গরমের ছুটিতে। ওই আমলকি গ্রামের রাজার মতো, যে রেগে গুপি গায়েনের মাটির তানপুরাটা ফেলে ভেঙে দিয়েছিলো। 'সুরবিতান' এ মৃত বাদ্যযন্ত্র ও আবার সুরে বলতো নাকি। বৃদ্ধ মালিকের তাই দাবী ছিল।

গরমের ছুটিতেই তো ক্যাসেটের বাক্স পরিষ্কার করতে হতো। বাটা থেকে জুতো কিনলেই বাক্স ফ্রি। মার্বেল পেপার দিয়ে সাজিয়ে বাক্সতে তুলো বিছানো হতো। তারপর এক এক করে ক্যাসেট সযত্নে রেখে দেওয়া। ওপরে লিখে রাখা: ডোন্ট টাচ ময়ূখ ঘোষ সং বক্স। হিন্দির আলাদা বাক্স, ইংলিশের আলাদা, মায়ের রবীন্দ্রসংগীত এর আলাদা। বাবার কি সব ছাইপাঁশ গণসংগীত, দ্রোহের গান, ব্রিগেডের বক্তৃতার ক্যাসেট ছিলো। ঠাঁই পেতো না আমার এলিট বাক্সে। ওসব এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো। হলদে হয়ে যাওয়া লালচে ফাইল, ফেস্টুন, চেন ফ্ল্যাগের মতো।

ভবানীপুরে এক মোটা চশমা, শীর্ণকায় দাদু বসতেন 'বাজনার' দোকানে। ও দোকানের মেঝেতে মোটা ধুলোর আস্তরণ থাকতো হরবখত। আর দেওয়াল জুরে বাদ্য। শোনা যায় ওসব ধুলো আর বাদ্য বিশ্ববরেণ্য সুরকার, গায়কদের। তাই সাফ হতো না। বদলে যেত না সিন্থেসাইজারে।

শিল্পীর স্টুডিওর মতো কারিগর আসতো সব ওই বালব লাগানো একখান দোকানে। নিঁখুত হাতে সুরযন্ত্র বানানো হতো। হারমোনিয়ামের  কাঠ সাধারণত শেগুন ও বার্মাটিকের হতো।হারমোনিয়ামের যে অংশ দিয়ে ভেতরে হাওয়া ঢোকানো হয়, তার নাম বেলু। এই বেলু তৈরিতে কাঠের সঙ্গে চৌকোনাভাবে এঁটে দেওয়া হতো পিসবোর্ড। যাকে আমরা রিড বলি। প্রস্তুতকারকদের কাছে তার নাম পর্দা। এর নিচেই থাকতো স্প্রিং। রিড বা পর্দা হয় দুই স্তরে সাজানো ৩৭ ও ৪২ ঘাটের। রিড নিয়ন্ত্রণ করে বাঁশিকে। প্রতিটি বাঁশি পিতলের পাতলা আবরণে রিডের প্রতিটি ঘাটের সঙ্গে সংযুক্ত করা থাকতো। কাঠামো তৈরির পর দেবীর চক্ষুদানের মতো কঠিন কাজ থাকতো সুর টিউনিং করা। ওর ওপরই নির্ভর করতো মান। আর যন্ত্র দাদুর দোকানের ইজ্জত।

এরপর দীর্ঘ ছায়াপথ হেঁটেছে সুর। ইলেকট্রিক গিটার, ডিজিটাল কী বোর্ড, পিয়ানো একার্ডিয়ান সবই পাল্টে ডিজিটাল হয়েছে, আই টিউন হয়েছে। দোকানটাও বোধহয় আশেপাশের সিনেমাহলগুলোর মতো বন্ধ। দাদু তো ছবি আর স্মৃতিতেই সুখের। শুধু কয়েকটি বাদ্যের পরিবর্তন হয়নি আজ ও। যেমন ঢোল, খোল, তবলা, বেহালা, হারমোনিয়াম, হারমোনিকা বা মাউথ অরগ্যান। খুব বেশী টক্কর দিতে পারছেনা ডিজিটাল যুগে কিন্তু  সুরের যন্ত্র প্রযুক্তিতে যতই আধুনিক হোক সপ্তসুর ও পঞ্চবোল ছাড়া কোন কিছুই সুরে বাজানো যায় না। কান্না ও না।

কান্না তো ভীষণ পায় আমার যখন প্রাণের থেকেও বেশী প্রিয় ক্যাসেট কাকুর দোকানের পাশ দিয়ে যাই। গোটা দোকান ভেঙে কিম্ভুত নামের এক শাড়ীর শোরুম হয়েছে। ওখানে গান বাজে না। স্টার জলসা চালানো থাকে। ক্যাসেট কাকুর কোত্থাও নেই। অথচ ওখানেই তো বলে আসতে হতো একটা ব্ল্যাংক ক্যাসেট ধরিয়ে আমার পছন্দের প্লে লিস্ট। এপিঠ ওপিঠ মিলিয়ে ২০টা গান কপি করে দিতো কাকু।

ওই দোকানেই তো এ.আর.রহমানের ক্যাসেট দেখলেই কিনে ফেলা। ফিলিপ্স এর হেড ক্লিনার কিনতে যাওয়া ছ'মাস অন্তর। প্রতি ভাইফোঁটাতে বোন আর দিদিকে নতুন যে ক্যাসেট এসেছে বাজারে তার এক কপি উপহার দেওয়া। বাচ্চাদের জন্য রত্না সাগরের নার্সারি রাইমস এর ক্যাসেট আর সোনাদাদুর জন্য ইয়ানি বা বিসমিল্লাহ র সানাই। কাজী সব্যসাচীর আবৃতির ক্যাসেট ও মাস্ট ছিলো। কান সেট করতে হতো। ক্যাসেট কাকু সব গান নিজে শুনে নিতো। না হলে ভালো ক্যাসেট বেচবে কিভাবে!

কান্না তো ভীষণ পায় আমার যখন প্ল্যানেট এম বা মিউজিক ওয়ার্ল্ড ঢুকবো ভেবেও ঢুকতে পারিনা। ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যাসেট, সিডি পরখ করতে পারিনা। ফ্রিতে নতুন নতুন গান কানে দামী হেডফোন গুঁজে শুনতে পারিনা। রোজ আসতে আসতে আমি, আমরা ওই নতুন গানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখবো বলে গানওলাদের মেরে ফেলেছিলাম।

মুম্বাই থাকাকালীন স্বপ্নের গায়কদের মুখোমুখি হয়েছি অনেকবার। ৯০' কাঁপানো নাম সব। বাড়িতে লজঝড়ে মার্সিডিজ আর পেল্লায় সব শোকেজ। গোল্ডেন হিট, প্ল্যাটিনাম ডিস্ক, ফিল্মফেয়ার, নস্টালজিয়া। চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় কে শানু, কে উদিত বা অভিজিৎ, কে সোনু বা শান কিংবা কবিতা ও ইয়াগনিক। কান্না তো ভীষণ পায় যখন এদের ব্যস্ততা বলতে মফস্বলের শো, রিয়েলিটি টেলিভিশন আর এদিক ওদিক ফিতে কাটা বোঝায়। কে বলবে এদেরই অনেকে একদিনে বারো চোদ্দোটা গান রেকর্ড করতো। একমাসে ডিসপ্লে ফাঁকা হয়ে যেত ক্যাসেটের দোকানের। জলসাঘরের ছবি বিশ্বাসের মতো আজ ও 'কাজ পেতে হাত পাতবো না' জেদ নিয়ে বেঁচে আছে এরা। স্টেজে উঠলেই ম্যাজিক। সুড়ুত করে নব্বই এর দশকে চলে যাই আর ফাংশন শেষ হলে ভেউভেউ করে কাঁদি।

সিডি, আইটিউন, ডাউনলোডস, পাইরেসি বাঘবন্দি খেলার মতো ঘিরে ফেলেছিলো আমার হারমোনিয়াম দাদু, ক্যাসেট কাকু আর গানওলাদের। ওরা গলা ছেড়ে আর্তনাদ করছিলো।  আমরা নয়েজ কারেকশন হেডফোন কানে এতোটাই মশগুল ছিলাম হানি শিং এ, শুনতে পাইনি।

হারমোনিয়াম দাদু শেষদিন অবধি সৎ ভাবে দেশীয় বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করে গেছে। সিন্থেসাইজারের কথা উঠতেই বলতো, বাজার থেকে কেনা আদা রসুনের পেস্ট আর শিলনোড়ায় বাটা কি এক হলো? বাজিকরের ডুগডুগি, যাত্রাপালার হারমোনিয়াম, সার্কাসের জোকারের ঘুঙুর, লাঠি খেলার ‘নাকারা’, পালাগানের দোতারা, খমক, মৃদঙ্গ, কঙ্গ, বঙ্গ, সানাই, তুরি, বেনু, করতাল, মন্দিরা, ঘণ্টা, সেতার- শেষদিন অবধি আগলে রেখেছিলো।

ক্যাসেট কাকু শেষদিন অবধি পাইরেটেড সিডি ঢুকতে দেয়নি দোকানে। দাঁতে দাঁত চেপে ওরিজিনাল সিনেমা আর গান বেচে গেছে বাঁধা খদ্দেরদের। একসময় পেনড্রাইভ দেখলে ও মাথা গরম করে ফেলতো। বিশাল সমুদ্র থেকে মগ দিয়ে জল বের করতো। ভেজাল বাদ দিয়ে নিখাদ শব্দ বিক্রি করতে চেয়েছিলো শেষদিন তক।

গানওলারা আজ ও কেউ দেখুক ছাই না দেখুক, কালো চশমা পরে ঘোরে। অটোগ্রাফ চাইলে নামটাও জেনে নিয়ে দুলাইন লিখে দেয়, পুরনো গান চলতে দেখলে সিগারেট এ একটা দীর্ঘ টান দিয়ে, রিং ছেড়ে বলে বসে: "ময়ূখ তুমি তো সেন্সিবল, সাংবাদিক।  Class আর Crass এর পার্থক্য টা করতে শেখো।"

©------ ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

Sunday, June 10, 2018

উড়ন্ত হাতি,ময়ূর আর যমের চিয়ার্স -মহুয়ার ইতিকথা

|উড়ন্ত হাতি,ময়ূর আর যমের চিয়ার্স -মহুয়ার ইতিকথা|

---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

জাতিস্মরের মত মহুয়া জন্ম থেকে জন্মান্তর ফিরে ফিরে এসেছে। ফিরে আসবে। কখনো হাতি বা ময়ূরের ঠোঁটে, কখনো মৃত্যু বা দেবতার ঠোঁটে, কখনো চাঁদনী রাতে শাল পিয়ালের মাঝে শুয়ে ঝিঝি শোনা আর আকাশ দেখা কোন ঠোঁটে। এসেছে দীর্ঘ চুম্বনের মতো। অনেককাল আগে এসেছে। প্রথমবার ডিস্টিল্ড হয়ে বোতলে পাওয়া যাচ্ছে। ফরেন লিকার হুঁশিয়ার।

সে অনেক হাজার বছর আগের কথা। এখন মধ্যভারতে যে অরন্য এলাকা গোন্ডা নামে পরিচিত সেখানে তখন নানা পশু, পাখির বাস। আকাশে বাতাশে মিষ্টি গন্ধ থাকে। ঝরনায় থাকে ঠান্ডা জল। গাছে গাছে ফল। ঘাসের ওপর ছায়া। এরকমই কোন এক সময় বনের রাজা নির্বাচন হচ্ছিল। সে ভীষণ লড়াই বনের কুরসি দখলের।

ভোটের শেষ ধাপে লড়ছিলো প্যাঁচা ও ময়ূর। টানটান লড়াই কিন্তু দুজনেই ভোট পেলো সমান সমান। এবার বনের রাজা বেছে নেওয়ার পালা। গোটা অরণ্য সিদ্ধান্ত নিলো বোকা হুলোমুখো রাতজাগা প্যাঁচা নয়, বরং ময়ূরকে রাজা বানানো হোক। দেখতে সুন্দর, সাথে আস্ত রাজসিংহাসনের মতো একটা পেখম ও আছে।

ময়ূর ভায়া ভোটে জিতে আনন্দে আত্মহারা। তার ওপর বৃষ্টি নামলো ঝমঝমিয়ে। কাছা খুলে...ইয়ে মানে পেখম মেলে সেলিব্রেশন শুরু করলো। সারা রাত নাচ এক প্রাচীন মহুয়া গাছের তলায়। নাচের চোটে ঝুম ঝুম করে মাটিতে পরতে থাকলো মহুয়া ফুল। বৃষ্টি, ঝোড়া হাওয়া, মাতাল করা মহুয়ার গন্ধ, রসের স্বাদ পাগল করে দেয় ময়ূর সাহেবকে। দিনক্ষণ ভুলে লাট হয়ে পরে থাকে গাছের ছায়ায়।

ওদিকে রাজ্যাভিষেকের লগ্ন সমাগত। সবাই উপস্থিত ময়ূরকে রাজা হিসেবে দেখবে বলে। কিন্তু ময়ূর কই? কোথাও খোঁজ নেই। নেই নেই কোথাও নেই। মহা ফ্যাসাদে পরলো বাকিরা। খুব বিরক্ত হয়ে শেষে প্রস্তাবিত হলো যে সংখ্যালঘু প্যাঁচাকেই রাজা বানানো হোক। ওই কুমারস্বামী যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রী হলো আরকি। সাথে আদেশ জাড়ি হলো সেই শত্রুকে খোঁজার যার কারনে ময়ূর সারারাত বুঁদ হয়ে থাকলো।

এরপর শোনা যায় মহুয়া জীব ও জন্তুদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয় হয়। বীজ থেকে তেল, ফল থেকে আচার, ফুল থেকে মদিরা, খোসা থেকে সবজি, পাতা থেকে কাপড় বানাবার পদ্ধতি আবিষ্কার হয়। কলাগাছের মতই মাথা থেকে পা অবধি সবটাই কাজে আসে। কেবল সুরা নয়। এ জীবনযাপনের অংশ হয়ে ওঠে যুগে যুগে।

মর্ত্যলোকের এই 'মদবৃক্ষ' দেবতাদের ও নজরে আসে। আমি তখনকার কথা বলছি যখন বিশ্বাসে মিলানো হতো বস্তু। মানুষ ম্যাজিকে বিশ্বাস করতো, রুপকথার গল্প শুনতো, চমৎকারে ভরসা রাখতো। এরকমই এক চমৎকার ঝকঝকে সকালে  দেবতারা উড়ন্ত হস্তি চেপে হাওয়া খেতে বেড়িয়েছিলো। আজ্ঞে! সেসময় হাতি আকাশে উড়তে সক্ষম ছিল। ইয়া বিশাল বিশাল হাতি সব দেব দেবতাদের ফেরি করে বেড়াতো এই লোক থেকে ওই লোক।

পূর্ব ভারতের বায়ুপথ ধরে যেতে যেতে এক ক্লান্ত দেবতা ও তার বাহন ঠিক করলো একটু মাঝপথে জিড়িয়ে নেবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কিন্তু কেলো করলো তার পোষা হাতি। মাঠভরা ফসল, গাছ ভরা আঁখ দেখেই সে হাবাতের মতো ঝাপিয়ে লুটোপুটি খেলো। ক্ষেতের মাঝেই ছিলো এক মহুয়াগাছ আর হাড়িতে রাখা পানীয়। গলা ভেজাতে হাতি চোঁ চোঁ করে মেরে দিলো গোটাটা। ব্যাস! সে ভয়ানক নেশা। মাতালামো শুরু হলো। লাপটে আর সাপটে খেলো ক্ষেত উজাড় করে। ডিগবাজি খেলো, স্কিট খেলো, মহুয়া গাছে দোল খেলো গোটা দুপুর।

ফিউরিয়াস গ্রামবাসী দেবতাকে ঘিরে ধরলো। বিহিত করুন নয়তো দৈবগুনে ফসল ফিরিয়ে দিন। হাতির মহুয়ায় নেশা লেগেছে, এ ব্যাটা ফিরে ফিরে আসবেই আবার ক্ষেত উজাড় করতে। দেবতার লজ্জায় মাথা কাটা গেলো। রেগে সে হাতির দু কান ধরে দিলো আছাড়। হাতি দু ভোল্ট খেয়ে তখনো মুচকি মুচকি হাসছে। নেশা মোটেও কাটেনি। ক্ষুব্ধ দেব হাতিকে অভিশাপ দিলো যে এরপর আর কোনদিন সে উড়তে পারবেনা। পাশাপাশি আজীবন যাতে তার এই অপরাধবোধ থাকে, সে হেলতে দুলতে চলবে শুধু। চঞ্চলতা ছিনিয়ে নেওয়া হলো তার থেকে। রেখে দেওয়া হলো ঝিমিয়ে থাকা মুখ, মুচকি হাসি আর স্থবিরতা। হাতি আজ ও উড়তে পারেনা। রেড বুল খেলে ও না। তবে মহুয়া খাওয়া ছাড়তে পারেনি ও।

আজকের উড়িষ্যা বা উৎকলদেশে মহুয়া দিয়ে যমকে সন্তুষ্ট করা হয়েছিলো। বোকা ও বানানো হতো। যম বলে কথা। কোন ভেজাল বা চোলাই তো দেওয়া যায় না তাই শ্রেষ্ঠতম সুরা পরিবেশন করতে হয় বোকা বানাতে গেলেও। কথায় আছে, একবার যমরাজ মৃত্যুদূতকে বলেছিলো কোন এক কাঠ মিস্ত্রিকে নিয়ে আসতে। মৃত্যুদূত খেয়ে দেয়ে পৃথিবীতে ল্যান্ড করে দুপুরবেলা।

তখন মৃত্যুদূত হলেও নিয়ম না খাইয়ে ঘর থেকে না ছাড়া। ওখানকার লোক তো খাইয়েই ছাড়বে। সাথে আবার দিয়েছে এক ভান্ড মহুয়া। নেশা ফেশা করে মৃত্যুদূত এলো এক ভুল লোককে যমালয়ে নিয়ে। যমরাজ খোঁচে বোম। ভাগ্যি বোগলে করে এক ক্যানেস্তারা মহুয়া এনেছিলো। তা খেয়ে শরীর মন ঠান্ডা হলো যমের। চিয়ার্স করে বলেছিলো নাকি, মহুয়া মৃত্যুকে ও ফাঁকি দিতে পারে যদি সঠিক পেগ বানানো হয়। আজ ও নাকি মৃত্যু সামনে এলে তাকে বসাতে হয়। দাবা খেলতে হয় দু পাত্তর খেতে খেতে। কে জানে মন বদলালে ও বদলাতে পারে মৃত্যুর জীবনের উল্লাস দেখে, কাঁচে কাঁচে ঠোকা লেগে জন্মানো শব্দ শুনে।

এহেন ইতিহাস, লোকগাথা, পুরাণ, কল্পকথা মেশানো এক সুরা কেবল ফারমেন্টেশনে হয়না। এতে আদর মেশাতে হয়, প্রকৃতির ভালোবাসা, কাঠের উনুনের ওম, হাড়িতে ফেলে রাখার অবহেলা মেশাতে হয়। তবে গিয়ে বোতলবন্দি হয় প্রযুক্তিগুনে।

যে সুরার যোগ্যতা ছিলো ভটকা, কনিয়াক, শেরি,শ্যাম্পেন, জিন, মারটিনি, মালিবুকে দশ গোল দেওয়ার তাকে সেঁধিয়ে দেওয়া হলো প্রত্যন্ত এলাকার কোন প্রান্তিক মানুষের রসনারুপে। এটা নিঃসন্দেহে ব্রিটিশদের কাজ। কেউ প্রতিবাদ করেনি। কেউ কথা রাখেনি একগেলাসি বন্ধুত্বের।

ফেলিক্স প্যাডেল সাহেব যিনি আবার চার্লস ডারউইনের বংশধর তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে এদেশে এসেছিলেন। মহুয়া চেখে আর একগুচ্ছ ব্যাবসাদার সাহেবের মতো শত্রু চিনতে পেরেছিলেন। মহুয়ার মতো একাধিক সুরা এদেশে বানানো হয়। এগুলোকে বাণিজ্যিক ভাবে একবার যদি বাজারে আনা হয় তবে হার ম্যাজেস্টির ধান্দা চৌপাঠ হয়ে যাবে। সুতরাং নিষেধাজ্ঞা জারি করো, বিপুল ট্যাক্স বসাও আর এর ফাঁকতালে ভারতে ছেয়ে ফেলো ফরেন লিকার দিয়ে।

ব্রিটেনের স্কচ উইস্কি জায়গা করে নিলো ভারতের সৌখিন ড্রইংরুমগুলোতে আর মহুয়া ক্রমশ প্রান্তিক হলো। ঠেলে ঠেলে গভীরতর কোন কোনে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। যেখানে সভ্যতা স্বীকৃতি দেয়না একে বাবুদের পানশালায়।

মুম্বাই ও গোয়াবাসী বন্ধুবর ডেসমন্ড ন্যাজারথ অনেকদিন ধরে নিজ উদ্বোগে বিভিন্ন সুরা ব্রিউ করেন। ডিস্টিল করেন, বোতলবন্দি করেন। ভারতের এ কোন ও কোনে লুকিয়ে থাকা সুরার প্রণালী মূলস্রোতে নিয়ে আসেন নেশায় চাপিয়ে। উগ্র জাতীয়তাবাদের যুগে ডেসমন্ড গুরু দায়িত্ব নিয়েছেন মহুয়াকে বোতলবন্দি করে Reverse colonisation এর।

অনেক উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির ড্রইংরুমে মৃদু আলো, নরম সোফা, দামী স্টিরিও থেকে আসা সুর শুনেছি একবোতল মহুয়া বদলে দিতে পারে মাদলের তালে। সোফা বদলে যেতে পারে শাল পিয়াল আর ঝড়ে পরা মহুয়া ফুলের নরম বিছানায়। এক আকাশ তারা, অনেক ওপরে তারা, তার ওপর থেকে কালোরঙ ভেদ করে কোন উজ্জ্বল নক্ষত্রাদি। মাদল বাজছে। আগুনে ঝলসানো হচ্ছে মাংস। উড়ন্ত হাতি,ময়ূর আর মৃত্যুদূত গোল হয়ে বসে। আপনার আর মহুয়ার ওই বোতলের পাশে। চিয়ার্স!

©------ ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

তথ্যসূত্র ও সহায়তা: Desmond Nazareth