কবির কদর নেই জীবদ্দশায়, কবির কবর দেয়া হয় না।
থাকলে,এপিটাফ কদর দিত/কোন নিষিদ্ধ প্রেমিকার মতো।

mayukh speaks

My photo
kolkata, west bengal, India
A media professional and a wanderer by passion. Blogger and social observer. loves to watch world films and hear different music genre.

Thursday, September 13, 2018

আপনবাপনদিল্লিযাপন - পর্ব ৩

#আপনবাপনদিল্লিযাপন - পর্ব ৩

| হুজুগে পাততাড়ি গোটায় ঝড়, পানশে ঝাপ্টা with 49 others |

----ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

আমরা যারা মহানগর নামক কংক্রিট জঙ্গলে থাকি। আমরা যারা উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির একটা কোন খোপ দিয়ে আকাশ দেখি আর রাতে ঝুল বারান্দায় সিগারেট খেতে খেতে দেখি তারা। আমরা যারা বাজারের থোলে হাতে অনলাইন আনাজপাতি কিনি আর ইনস্টাগ্রামে ভিন্ডি আলুর ছবি পোষ্ট করি রোজ। আমরা যারা সমস্বরে টুইট করে ট্রেন্ড করি ঝড়, তারা বড্ড হ্যাংলাথেরিয়ামে ভুগি। এ অসুখ ক্রনিক অসুখ। এন্টিবায়োটিক রেসিস্টেন্স এর ফলে কঠিন এ রোগ সারানো।

প্রবল ঝড় ধেয়ে আসছে বলে দেশের অর্ধেক রাজ্যেই সতর্কতা জারি করেছিল আবহাওয়া দপ্তর। সরকারি হাওয়া বাবুরা ১০০র নিচে গতি ভাবতেই পারছিল না। বেসরকারি পেশাদারেরা ৭০ এ। চ্যানেলে ওয়েবে কাউন্টডাউন শুরু আছড়ে পরার। শট ডিভিশন হয়ে গেছে। ফ্রেমের বাঁদিকে ভাঙা ঘর নিশ্চই থাকবে, সেন্টারে উপড়ে পরেছে গাছ কোন দামি গাড়ির চালে, এদিক ওদিক পাতা ছড়ানো পিচের রাস্তায়, যত্র তত্র প্লাস্টিক পরে থাকবে বা ভাগ্য সদয় হলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া লাশ। আর অনেক অনেক ঝোড়ো হাওয়ার স্টক শট। ব্রেকিং নিউজ বানিয়ে রাখার অপেক্ষা ছিল।

দিল্লির চারপাশের রাজ্য দিয়ে ঝড় ধেয়ে আসছে সন্ধে থেকে। ছবি ঢুকছে, খবর ঢুকছে। এ যেন Marvel series এর Thanos এর এন্ট্রি। রুদ্ধশ্বাস প্রতিক্ষা। ধুলোর ঝড়ে এলোমেলো হয়ে যাবে নয়ডা-দিল্লি-গুরুগ্রাম। সিনেমায় যেমনটি হয়।

আমি যদ্দিন আর নিউজ চ্যানেলে কাজ করবো, তদ্দিনই সম্ভবত প্রাইমটাইমের খাঁড়া মাথায় ঝুলবে। তদ্দিনই বোধহয় দুপুরবেলা থেকে মধ্যরাতের এই শিফট থাকবে। আজ ও যেমনটি ছিল। আমি নিউজরুমে, গিন্নী ফ্ল্যাটে। সেই দুপুর থেকে ঘোষণা করে দিয়েছি ঘরোয়া ওয়াটসাপ গ্রুপ গুলোতে সাবধানে থেকো হে। ঝড় বিকেলে আছড়ে পরবে। কলকাতাতে ও ঘন ঘন ফোন করে খোঁজ নিচ্ছি খবরের সত্যতা মিললো কিনা।

এ ঝড় ওই কলেজের সুন্দরী জুনিয়ারটির মত। চিনচিনে ব্যাথা দিয়ে যাবে ওড়নার ফাঁক দিয়ে, ধরা দেবে না। বিকেল বলে সন্ধে হল, সন্ধে হল রাত, এখনো কুমির এলো না। আশা শেষ। হাওয়া বাবুদের প্রতি ভক্তি শেষ। ঝড়ের মত গুরুগম্ভীর একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে ক্রমশ মনে হচ্ছে রাইটার্স বিল্ডিং এ আটকে থাকা পেনশনভোগীর ফাইলের মত। আসবে কিন্তু আসছে না।

বউকে ইতিমধ্যে তিনবার বলে দিয়েছি গোটা ফ্ল্যাটের দরজা জানালা ভিতর থেকে সিল করে দিয়ে চুপটি করে ঝড় দেখতে। প্রথম দেখা দিল্লির ধুলো ঝড়। ধুলো কুন্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠে যাবে।  ওই যে যেসব ধুলোর মধ্যে থেকে লর্ড ভলডেমর্ট জেগে ওঠে। এরপর বিদ্যুৎ চমকাবে। হয়তো বা বৃষ্টি হবে এ রুক্ষতায়।

দূর ছাই। কোথাও কিচ্ছু নেই। প্রায় সারে দশটা নাগাদ খবর এলো হরিয়ানার রোহতাকে ঝড় হচ্ছে। সাথে বৃষ্টির ঝাপটা। রোহতাক থেকে দিল্লি খুব দূরে নয়। আবার আশায় বুক বাঁধলো পাতলা হয়ে যাওয়া নিউজরুম। নিশ্চই এবার এন্টেনা উপড়ে যাবে। সমস্ত হোর্ডিং দুমড়ে মুচড়ে যাবে। ধুলো ঢুকে আসবে ক্যামেরার লেন্সে। সে এক অদ্ভুত সেডিস্টিক প্লেজার। ধ্বংস ধরা থাকবে । মধ্যরাতে উত্তেজনা হবে টিভির পর্দা জুরে।

মানুষ যত সভ্য হচ্ছে তত তার অসভ্যতা, আদেখলাপনা বাড়ছে। যে ভাবে মানুষের বনভোজনের বা দারুণ দাপাদাপির কারণে বন্যপ্রাণী আর সচারচর আর দেখা যায় চেনা বনে, সেখাবে প্রাকৃতিক ঘটনাচক্র ও নিজের দিক পরিবর্তন করছে হয়তো মানুষের এই হ্যাংলামোতে।

সামান্য হাওয়া দিলো কি দিলো না, ছেয়ে দিলাম টুইটার ফেসবুক, চ্যানেলের টিকারে "আছড়ে পরলো", "আশংকা সত্যি হল", "মধ্যরাতে সাইক্লোনের কড়া নাড়া" ইত্যাদিতে।

১২ ঘন্টায় ৩০০ মিমি বৃষ্টিপাতেই বন্যা আখ্যা দেওয়া হয় মুম্বাই এ। বৃষ্টি ফোঁটা মাটি স্পর্শ করলো কি করলো না স্বস্তি বলা হয় হেডলাইনে। আজ ৬০ কিমি এ বয়ে চলা হাওয়াকেই ঝড় বলে চালিয়ে দিলাম। মজা পেলাম টুইটার ট্রেন্ডে।

এসব ঝড়ের শেষে ম্যাক্সি পড়ে কুকুর নিয়ে ও ফ্ল্যাটের মিসেস চৌবের খোঁজ নিয়ে হয়। ঝড়ে কোন ঝাড়বাতির কাঁচ নষ্ট হল কিনা। এসব ঝড়ের শেষে খালি গায়ে ফিউজ ঠিকঠাক আছে কিনা, গাড়িটা অক্ষত আছে কিনা দেখতে যেতে হয়।

আমরা মহানগর নামক কংক্রিট জঙ্গলে থাকি। আমরা উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির একটা কোন খোপ দিয়ে আকাশ দেখি আর রাতে ঝুল বারান্দায় সিগারেট খেতে খেতে দেখি তারা। আমরা বাজারের থোলে হাতে অনলাইন আনাজপাতি কিনি আর ইনস্টাগ্রামে ভিন্ডি আলুর ছবি পোষ্ট করি রোজ। আমরা সমস্বরে টুইট করে ট্রেন্ড করি ঝড়।

আমাদের বয়েই গেল ঝড়ের দাপটে ত্রিপূরার কোন অখ্যাত গ্রামে ১০জন মারা গেলে। আমাদের বয়েই গেল গাছ পরে কোন নাইটগার্ড আহত হলে। আমাদের বয়েই গেল শয়ে শয়ে ঝুপড়ি ঝড়ে উড়ে গেলে। খোলা আকাশের নিচে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, দশ মাসের শিশু, আবাল বৃদ্ধ বনিতা রাত কাটালে।

মিঠে এসির হাওয়া, কাঁচের ওপারে সোঁ সোঁ শব্দ, টুইটারে,ফেসবুকে ঝোড়ো আপডেট আর টিভিতে একরাশ উতকন্ঠা নিয়ে কোন সংবাদপাঠিকা যতক্ষণ আমাদের শহুরে হ্যাংলাপনার ঝাপ্টা দিয়ে যাচ্ছে, আমরা ততক্ষণ সেফ with 49 others।

©---- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

No comments:

Post a Comment