| রবি ঠাকুরকে গনহত্যার মামলায় সমন |
©---ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই তুমি?
যে বৈশাখ বদলে দিলো জন্মভূমি।
মধ্যবর্তী যেই বা আসলো খরকুটো,
শ্রাবণ মাসের বাইশে সমন/
মৃত্যু গুনি।
গুরুদেব প্রনাম। আপনার লেখা পড়ে বড়ই আনন্দ অনুভব করি। কিন্তু এই চিঠি লিখে আমি আপনার লেখা গান, কবিতা বা গদ্যের প্রশংসা করতে পারলাম না। আমি অপারগ।
এই লেখা মারফৎ আপনাকে সমন করা রবীন্দ্র সদন চত্বরে। একটি মৃতদেহদের আদালতে।
শ্রী রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আপনার বিরুদ্ধে IPC 301,302,306, 307 সহ একাধিক জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করেছে কিছু মৃতব্যক্তি। জীবদ্দশায় তাদের মধ্যে কেউ কেউ হাফসোল কবি, ক্ষ্যাপা লেখক বা চিত্রকর হিসেবে পরিচিত ছিল।
আপনার হাতে যদি শতবার হাত ধোয়ার পরেও দোয়াতের কালি লেগে থাকে,তবে তা আপনার ভ্রান্তি। কলম বিলাস কখন ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠেছে আপনি নিজেও জানেন না। ভালো করে গোল চশমা পরে হাত দুটো দেখুন। দেখবেন তাতে রক্ত লেগে কত অখ্যাত লেখকের। যারা আপনার তলায় চাপা পড়ে গেছিল।
অনেক দিস্তা কাগজ কলম খরচা করেও নতুন কিছু লিখতে পারেনি। প্রতি বছর প্রতি রাতে পায়চারি করেছে এ ঘর ও ঘর। যাই লিখতে গেছে, আপনি তা অনেক বছর আগে লিখে ফেলেছেন। বেচারা লিখে আবার কুচি কুচি করে সেই কাগজ ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কেবল সিলিং ফ্যান সাক্ষী ছিল এদের ব্যর্থতার। এদের না লিখতে পারা গল্পের। এদের না ভাবতে পারা মৌলিকতার। শেষে ওই সিলিং ফ্যানেই গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় পাওয়া গেছিল এদের। এক বিশাল গোলাছুটের মাঠে।
যেভাবে সারাজীবন কেরানি হয়ে থেকে গেছিল কেউ কেউ কারন লেখক হতে চাইলেও নতুন কিছু লিখতে পারেনি। পারেনা। তবে পড়তে ভালোবাসে। পড়েও। পানু থেকে কামু।
আপনার সাথে আমার পরিচয় নিতান্তই বাড়ির চাপে। জোর করে মা দুটো গান আর তিনটে কবিতা মুখস্থ করিয়ে রেখেছিল। যেখানেই হোক, আউড়ে দিতাম। এতে শুনেছি মায়ের শান্তিতে ঘুম হতো।
এভাবে জোর করতে করতে একদিন কিছু কথার মানে বুঝতে শুরু করি। মানে বুঝে মন দিয়ে গেয়ে ফেললাম কিন্তু আপনার স্বঘোষিত স্তাবক-চ্যালার দল আমাদের ধমকালো। " বাবা, রবি ঠাকুরের গান রবিন্দ্রসঙ্গীত এর মতো গাও, এটা লাড়ে লাপ্পা নয়। একটু সিরিয়াস হও!!!!
কিভাবে হই। কিভাবে গাই। আমার তো WALKMan প্রজন্মে জন্ম। পরদেশী পরদেশী জানা নেহি গাইতে বেশি আনন্দ। এ আর রহমান আর চন্দ্রবিন্দু ভগবান। আপনি তো কেবল মা বাবার শাসন আর ইচ্ছেতে। আমার কৈশোরে বিনোদ রাঠোর। আমার কৈশোর এ বাড়ির শক্ত শাসন হারমোনিয়াম এর।
গুরুদেব আপনি অজান্তেই বহু মানুষের, বহু প্রতিভা, বহু সম্ভাবনার অকাল মৃত্যুর কারণ। তারা আপনার তলায় পিষ্ট হয়ে থেকে গেছে রবীন্দ্র সদন এর গাছে, নন্দন এর পাচিঁলে বা মোহরকুঞ্জতে। এদের সাধারণ মানুষ ভূত, দৈত্য বা পিষাচ বলে- আমরা বলি ব্যর্থ।
এরা এতটাই ব্যর্থ আর অপদার্থ যে পঁচিশে বৈশাখ এরা অদ্ভুতুরে কান্ড ঘটাতে পারে না, রবি ঠাকুর কে ভেঙে চুরমার করে একটা নতুন লেখা, ছবি, একটা গান গাইতে, লিখতে পারে না। ভয় পায়। গরুর মাংস ফ্রিজে রাখলে যে ভয় আছে আরকি।
আজ পচিশে বৈশাখ আপনি আসুন এই মৃতদেহ গুলোর সামনে। সালিশি হোক। আপনি কি সত্যিই গোঁড়া ছিলেন না ওই বাটিক ছাপ রাবীন্দ্রিক মৌলবিরা আপনার আপাদমস্তক মোল্ডিং করে? ঠিক যেভাবে প্যালেস্টাইন এর যিশু কখন যেন গির্জার শৃঙ্খল এ ফাদার এ বিদ্ধ। আপনি ও তো বিদ্ধ। সিনেমা শুরুর আগে। একজন ও না দাঁড়ালে সে এন্টি-ন্যাশনাল।
আপনার মত লিখতে হবেই? গাইতে হবেই? একই বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতে হবেই আপনার সুরে? না করলেই নাম খোদাই করে দেওয়া হবে কপালে- জর্জ বিশ্বাস?
হাজার হাজার মৃত কবি,লেখক, গায়ক আজ এসেছে আপনার কথা শুনতে। আপনি আসুন। আপনার ওজনে দুমড়ানো মোচড়ানো প্রতিভাগুলো একসাথে হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে। বুকে নতুন কিছু আইডিয়া, একটা কথার মোচড়, কিছু সুর ঠাসা বিস্ফোরক নিয়ে।
আপনি নেমে আসুন কবি। ধর্ম নিয়ে ফের লিখতে হবে। মুক্তমনাদের চাপাতির কোপ থেকে বাঁচানোর জন্য লিখতে হবে। কানামাছি খেলার মত যাকে পাবি তাকে দেশবিরোধীর তকমা লাগানোর বিরুদ্ধবাদ করতে হবে। ভারতবর্ষ মানে যে শুধু হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান নয়, সে গান গাইতে হবে।
সেদিন বিধাতা একা রবেন বসে, নীলিমাহীন আকাশে, ব্যক্তিত্বহারা অস্তিত্বের গনিততত্ব নিয়ে।
ছ'ফুট তখন জোব্বা পরে, অস্থির পায়চারি করছে। পাশের গ্রামের কালো হরিন চোখে কে বা কারা যেন এসিড ছুঁড়ে মেরেছে। ছোট নদীর মাঝিকে কে যেন হুমকি দিয়ে গেছে। নৌকায় ভারত মাতা কি জয় লেখা বাধ্যতামূলক। লালন সাঁই কি অহিন্দু? রামনবমীর দিন ঘর ওয়াপসির তোরজোড় করছে এক দল। একতারার বদলে ত্রিশূল নিতে হবে। ওদিকে একের পর এক ধানের গোলা জ্বলছে গুজবের আগুনে।
রেডিওতে সদ্য জন গন মন শেষ হল। এবার অনন্ত, অসংখ্য, লোকে লোকান্তরে এ বানী ধ্বনিত হবে। হবেই। মিঁত্রোওওওওও...............
---©---ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ